আসমানী

জসীমউদ্দীন

আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,
রহিমন্দীর ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।
বাড়ি তো নয় পাখির বাসা-ভেন্না পাতার ছানি,
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।
একটুখানি হওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,
তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।
পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের ক’খান হাড়,
সাক্ষী দেছে অনাহারে কদিন গেছে তার।
মিষ্টি তাহার মুখটি হতে হাসির প্রদীপ-রাশি
থাপড়েতে নিবিয়ে গেছে দারুণ অভাব আসি।
পরণে তার শতেক তালির শতেক ছেঁড়া বাস,
সোনালী তার গার বরণের করছে উপহাস।
ভোমর-কালো চোখ দুটিতে নাই কৌতুক-হাসি,
সেখান দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু রাশি রাশি।
বাঁশীর মত সুরটি গলায় ক্ষয় হল তাই কেঁদে,
হয়নি সুযোগ লয় যে সে-সুর গানের সুরে বেঁধে।
আসমানীদের বাড়ির ধারে পদ্ম-পুকুর ভরে
ব্যাঙের ছানা শ্যাওলা-পানা কিল-বিল-বিল করে।
ম্যালেরিয়ার মশক সেথা বিষ গুলিছে জলে,
সেই জলেতে রান্না খাওয়া আসমানীদের চলে।
পেটটি তাহার দুলছে পিলেয়, নিতুই যে জ্বর তার,
বৈদ্য ডেকে ওষুধ করে পয়সা নাহি আর।
খোসমানী আর আসমানী যে রয় দুইটি দেশে,
কও তো যাদু, কারে নেবে অধিক ভালবেসে?

এত হাসি কোথায় পেলে

 জসীমউদ্দীন

এত হাসি কোথায় পেলে
এত কথার খলখলানি 
কে দিয়েছে মুখটি ভরে
কোন বা গাঙের কলকলানি।
কে দিয়েছে রঙিন ঠোঁটে
কলমী ফুলের গুলগুলানি।
কে দিয়েছে চলন বলন
কোন সে লতার দোল দুলানী।
কাদের ঘরে রঙিন পুতুল
আদরে যে টইটুবানি।
কে এনেছে বরণ ডালায়
পাটের বনের বউটুবানী।
কাদের পাড়ার ঝামুর ঝুমুর
কাদের আদর গড়গড়ানি
কাদের দেশের কোন সে চাঁদের
জোছনা ফিনিক ফুল ছড়ানি।
তোমায় আদর করতে আমার
মন যে হলো উড়উড়ানি
উড়ে গেলাম সুরে পেলাম
ছড়ার গড়ার গড়গড়ানি।

নিমন্ত্রণ

 জসীমউদ্দীন



তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;
মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,
মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়,
তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,
ছোট গাঁওখানি- ছোট নদী চলে, তারি একপাশ দিয়া,
কালো জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া;
ঘাটের কিনারে আছে বাঁধা তরী
পারের খবর টানাটানি করি;
বিনাসুতি মালা গাথিছে নিতুই এপার ওপার দিয়া;
বাঁকা ফাঁদ পেতে টানিয়া আনিছে দুইটি তটের হিয়া।
তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সাথে, ছোট সে কাজল গাঁয়,
গলাগলি ধরি কলা বন; যেন ঘিরিয়া রয়েছে তায়।
সরু পথ খানি সুতায় বাঁধিয়া
দূর পথিকেরে আনিছে টানিয়া,
বনের হাওয়ায়, গাছের ছায়ায়, ধরিয়া রাখিবে তায়,
বুকখানি তার ভরে দেবে বুঝি, মায়া আর মমতায়!
তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে – নরম ঘাসের পাতে
চম্বন রাখি অধরখানিতে মেজে লয়ো নিরালাতে।
তেলাকুচা – লতা গলায় পরিয়া
মেঠো ফুলে নিও আঁচল ভরিয়া,
হেথায় সেথায় ভাব করো তুমি বুনো পাখিদের সাথে,
তোমার গায়ের রংখানি তুমি দেখিবে তাদের পাতে।
তুমি যদি যাও আমাদের গাঁয়ে, তোমারে সঙ্গে করি
নদীর ওপারে চলে যাই তবে লইয়া ঘাটের তরী।
মাঠের যত না রাখাল ডাকিয়া
তোর সনে দেই মিতালী করিয়া
ঢেলা কুড়িইয়া গড়ি ইমারত সারা দিনমান ধরি,
সত্যিকারের নগর ভুলিয়া নকল নগর গড়ি।
তুমি যদি যাও – দেখিবে সেখানে মটর লতার সনে,
সীম আর সীম – হাত বাড়াইলে মুঠি ভরে সেই খানে।
তুমি যদি যাও সে – সব কুড়ায়ে
নাড়ার আগুনে পোড়ায়ে পোড়ায়ে,
খাব আর যত গেঁঢো – চাষীদের ডাকিয়া নিমন্ত্রণে,
হাসিয়া হাসিয়া মুঠি মুঠি তাহা বিলাইব দুইজনে।
তুমি যদি যাও – শালুক কুড়ায়ে, খুব – খুব বড় করে,
এমন একটি গাঁথিব মালা যা দেখনি কাহারো করে,
কারেও দেব না, তুমি যদি চাও
আচ্ছা না হয় দিয়ে দেব তাও,
মালাটিরে তুমি রাখিও কিন্তু শক্ত করিয়া ধরে,
ও পাড়াব সব দুষ্ট ছেলেরা নিতে পারে জোর করে;
সন্ধ্যা হইলে ঘরে ফিরে যাব, মা যদি বকিতে চায়,
মতলব কিছু আঁটির যাহাতে খুশী তারে করা যায়!
লাল আলোয়ানে ঘুঁটে কুড়াইয়া
বেঁধে নিয়ে যাব মাথায় করিয়া
এত ঘুষ পেয়ে যদি বা তাহার মন না উঠিতে চায়,
বলিব – কালিকে মটরের শাক এনে দেব বহু তায়।
খুব ভোর ক’রে উঠিতে হইবে, সূয্যি উঠারও আগে,
কারেও ক’বি না, দেখিস্ পায়ের শব্দে কেহ না জাগে
রেল সড়কের ছোট খাদ ভরে
ডানকিনে মাছ কিলবিল করে;
কাদার বাঁধন গাঁথি মাঝামাঝি জল সেঁচে আগে ভাগে
সব মাছগুলো কুড়ায়ে আনিব কাহারো জানার আগে।
ভর দুপুরেতে এক রাশ কাঁদা আর এক রাশ মাছ,
কাপড়ে জড়ায়ে ফিরিয়া আসিব আপন বাড়ির কাছ।
ওরে মুখ – পোড়া ওরে রে বাঁদর।
গালি – ভরা মার অমনি আদর,
কতদিন আমি শুনি নারে ভাই আমার মায়ের পাছ;
যাবি তুই ভাই, আমাদের গাঁয়ে যেথা ঘন কালো গাছ।
যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়।
ঘন কালো বন – মায়া মমতায় বেঁধেছে বনের বায়।
গাছের ছায়ায় বনের লতায়
মোর শিশুকাল লুকায়েছে হায়!
আজি সে – সব সরায়ে সরায়ে খুজিয়া লইব তায়,
যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গায়।
তোরে নিয়ে যাব আমাদের গাঁয়ে ঘন-পল্লব তলে
লুকায়ে থাকিস্, খুজে যেন কেহ পায় না কোনই বলে।
মেঠো কোন ফুল কুড়াইতে যেয়ে,
হারাইয়া যাস্ পথ নাহি পেয়ে;
অলস দেহটি মাটিতে বিছায়ে ঘুমাস সন্ধ্যা হলে,
সারা গাঁও আমি খুজিয়া ফিরিব তোরি নাম বলে বলে।

কবর-

জসীমউদ্দীন

এই খানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা,
সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা!
সোনালি ঊষার সোনামুখ তার আমার নয়নে ভরি
লাঙল লইয়া খেতে ছুটিলাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি।
যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত
এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোরে তামাশা করিত শত।
এমনি করিয়া জানি না কখন জীবনের সাথে মিশে
ছোট-খাট তার হাসি ব্যথা মাঝে হারা হয়ে গেনু দিশে।
বাপের বাড়িতে যাইবার কাল কহিত ধরিয়া পা
আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ।
শাপলার হাটে তরমুজ বেচি পয়সা করি দেড়ী,
পুঁতির মালার একছড়া নিতে কখনও হত না দেরি।
দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে,
সন্ধাবেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুরবাড়ির বাটে!
হেস না হেস না শোন দাদু, সেই তামাক মাজন পেয়ে,
দাদি যে তোমার কত খুশি হত দেখিতিস যদি চেয়ে!
নথ নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া, এতদিন পরে এলে,
পথ পানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেঁদে মরি আঁখিজলে।
আমারে ছাড়িয়া এত ব্যথা যার কেমন করিয়া হায়,
কবর দেশেতে ঘুমায়ে রয়েছে নিঝঝুম নিরালায়!
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা! দয়াময়,
আমার দাদীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নসিব হয়।
তারপর এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি
যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি।
শত কাফনের, শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি,
গণিয়া গণিয়া ভুল করে গণি সারা দিনরাত জাগি।
এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে,
গাড়িয়া দিয়াছি কত সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে।
মাটিরে আমি যে বড় ভালবাসি, মাটিতে মিশায়ে বুক,
আয়-আয় দাদু, গলাগলি ধরি কেঁদে যদি হয় সুখ।
এইখানে তোর বাপজি ঘুমায়, এইখানে তোর মা,
কাঁদছিস তুই? কী করিব দাদু! পরাণ যে মানে না।
সেই ফালগুনে বাপ তোর এসে কহিল আমারে ডাকি,
বা-জান, আমার শরীর আজিকে কী যে করে থাকি থাকি।
ঘরের মেঝেতে সপটি বিছায়ে কহিলাম বাছা শোও,
সেই শোওয়া তার শেষ শোওয়া হবে তাহা কী জানিত কেউ?
গোরের কাফনে সাজায়ে তাহারে চলিলাম যবে বয়ে,
তুমি যে কহিলা বা-জানরে মোর কোথা যাও দাদু লয়ে?
তোমার কথার উত্তর দিতে কথা থেমে গেল মুখে,
সারা দুনিয়ার যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুখে!
তোমার বাপের লাঙল-জোয়াল দুহাতে জঢ়ায়ে ধরি,
তোমার মায়ে যে কতই কাঁদিতে সারা দিনমান ভরি।
গাছের পাতার সেই বেদনায় বুনো পথে যেতো ঝরে,
ফালগুনী হাওয়া কাঁদিয়া উঠিত শুনো-মাঠখানি ভরে।
পথ দিয়া যেতে গেঁয়ো পথিকেরা মুছিয়া যাইত চোখ,
চরণে তাদের কাঁদিয়া উঠিত গাছের পাতার শোক।
আথালে দুইটি জোয়ান বলদ সারা মাঠ পানে চাহি,
হাম্বা রবেতে বুক ফাটাইত নয়নের জলে নাহি।
গলাটি তাদের জড়ায়ে ধরিয়া কাঁদিত তোমার মা,
চোখের জলের গহীন সায়রে ডুবায়ে সকল গাঁ।
ঊদাসিনী সেই পল্লী-বালার নয়নের জল বুঝি,
কবর দেশের আন্ধারে ঘরে পথ পেয়েছিল খুজি।
তাই জীবনের প্রথম বেলায় ডাকিয়া আনিল সাঁঝ,
হায় অভাগিনী আপনি পরিল মরণ-বিষের তাজ।
মরিবার কালে তোরে কাছে ডেকে কহিল, বাছারে যাই,
বড় ব্যথা র’ল, দুনিয়াতে তোর মা বলিতে কেহ নাই;
দুলাল আমার, যাদুরে আমার, লক্ষী আমার ওরে,
কত ব্যথা মোর আমি জানি বাছা ছাড়িয়া যাইতে তোরে।
ফোঁটায় ফোঁটায় দুইটি গন্ড ভিজায়ে নয়নজলে,
কী জানি আশিস করে গেল তোরে মরণব্যথার ছলে।
ক্ষণপরে মোরে ডাকিয়া কহিল আমার কবর গায়
স্বামীর মাথার মাথালখানিরে ঝুলাইয়া দিও বায়।
সেই যে মাথাল পচিয়া গলিয়া মিশেছে মাটির সনে,
পরাণের ব্যথা মরে নাকো সে যে কেঁদে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে।
জোড়মানিকেরা ঘুমায়ে রয়েছে এইখানে তরুছায়,
গাছের শাখারা স্নেহের মায়ায় লুটায়ে পড়েছে গায়।
জোনকিমেয়েরা সারারাত জাগি জ্বালাইয়া দেয় আলো,
ঝিঁঝিরা বাজায় ঘুমের নূপুর কত যেন বেসে ভালো।
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, রহমান খোদা! আয়;
ভেস্ত নসিব করিও আজিকে আমার বাপ ও মায়!
এখানে তোর বুজির কবর, পরীর মতন মেয়ে,
বিয়ে দিয়েছিনু কাজিদের বাড়ি বনিয়াদি ঘর পেয়ে।
এত আদরের বুজিরে তাহারা ভালবাসিত না মোটে,
হাতেতে যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে।
খবরের পর খবর পাঠাত, দাদু যেন কাল এসে
দুদিনের তরে নিয়ে যায় মোরে বাপের বাড়ির দেশে।
শ্বশুর তাহার কশাই চামার, চাহে কি ছাড়িয়া দিতে
অনেক কহিয়া সেবার তাহারে আনিলাম এক শীতে।
সেই সোনামুখ মলিন হয়েছে ফোটে না সেথায় হাসি,
কালো দুটি চোখে রহিয়া রহিয়া অশ্রু উঠিছে ভাসি।
বাপের মায়ের কবরে বসিয়া কাঁদিয়া কাটাত দিন,
কে জানিত হায়, তাহারও পরাণে বাজিবে মরণবীণ!
কী জানি পচানো জ্বরেতে ধরিল আর উঠিল না ফিরে,
এইখানে তারে কবর দিয়েছি দেখে যাও দাদু! ধীরে।
ব্যথাতুরা সেই হতভাগিনীরে বাসে নাই কেহ ভালো,
কবরে তাহার জড়ায়ে রয়েছে বুনো ঘাসগুলি কালো।
বনের ঘুঘুরা উহু উহু করি কেঁদে মরে রাতদিন,
পাতায় পাতায় কেঁপে উঠে যেন তারি বেদনার বীণ।
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা! দয়াময়।
আমার বুজীর তরেতে যেন গো বেস্ত নসিব হয়।
হেথায় ঘুমায় তোর ছোট ফুপু, সাত বছরের মেয়ে,
রামধনু বুঝি নেমে এসেছিল ভেস্তের দ্বার বেয়ে।
ছোট বয়সেই মায়েরে হারায়ে কী জানি ভাবিত সদা,
অতটুকু বুকে লুকাইয়াছিল কে জানিত কত ব্যথা!
ফুলের মতন মুখখানি তার দেখিতাম যবে চেয়ে,
তোমার দাদির ছবিখানি মোর হদয়ে উঠিত ছেয়ে।
বুকেতে তাহারে জড়ায়ে ধরিয়া কেঁদে হইতাম সারা,
রঙিন সাঁঝেরে ধুয়ে মুছে দিত মোদের চোখের ধারা।
একদিন গেনু গজনার হাটে তাহারে রাখিয়া ঘরে,
ফিরে এসে দেখি সোনার প্রতিমা লুটায় পথের পরে।
সেই সোনামুখ গোলগাল হাত সকলি তেমন আছে।
কী জানি সাপের দংশন পেয়ে মা আমার চলে গেছে।
আপন হস্তে সোনার প্রতিমা কবরে দিলাম গাড়ি,
দাদু! ধরধর বুক ফেটে যায়, আর বুঝি নাহি পারি।
এইখানে এই কবরের পাশে আরও কাছে আয় দাদু,
কথা কস নাকো, জাগিয়া উটিবে ঘুমভোলা মোর যাদু।
আস্তে আস্তে খুঁড়ে দেখ দেখি কঠিন মাটির তলে,
ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিয়ে ঘন আবিরের রাগে,
অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।
মজিদ হইতে আযান হাঁকিছে বড় সুকরুণ সুরে,
মোর জীবনের রোজকেয়ামত ভাবিতেছি কত দূরে।
জোড়হাত দাদু মোনাজাত কর, আয় খোদা! রহমান।
ভেস্ত নসিব করিও সকল মৃত্যুব্যথিত প্রাণ।

ডান্স ডান্স ডান্স

----------------------------------বাকঝাল


আয়রে লাকী, আযরে চৈতি
আয়রে আমার প্রভা, প্রাচী
আয়রে দোলে কাপড় খুলে
উদাম তালে নাচি
নতুন আসল ঐশী এবার
তাকেও দে চান্স
দে দে দেরে সবাই ডান্স ডান্স ডান্স
আয়রে আমার এমরান সরকার
আয়রে আমার জাফর স্যার
নাটের গুরু তোমরা থাকলে
চাইনা কিছু আর
দেহ মন উজাড় করে
নাচব শুধু আজ
দে দে দেরে সবাই ডান্স ডান্স ডান্স
আয় পরিমল, আয়রে আমার পান্না
তসলিমকেও সংগে আানিস একলা আসিসনা
জলতরংগে জলকেলি হোক লোকে বলাবলি
দেহ মন উতাল হল উচ্ছন্নে যাব আজ
দে দে দেরে সবাই ডান্স ডান্স ডান্স

প্রাণহীন সৃষ্টি


আমার গানের খাঁচায়
বন্দী যে সব কথা
তারা হারালে প্রাণ
কেউ গাইবে না গান।
আমার কাব্যের স্তবকে
সজ্জিত যে সব কুসুম
জখম হলেই তারা
কবিতা হবে দিশাহারা।
আমার প্রবন্ধের মাঝে
বিরাজিত যে সব শব্দ
উচ্চারিত হলেই ভুল
সুবাস হারাবে ফুল।

চেনা সুরে নতুন গান


হাজার অজানা তারার মাঝে
উজ্জ্বল যেমন শশী 
অচেনা গানের চেয়ে চেনা সুর
আমার পছন্দের বেশি।
চেনা গান আমার
অস্থির করে মন
ভরিয়ে দেয় চিত্ত
জ্যোছনা যেমন।
তাই আমি ঘুমের
মাঝেও দেখি স্বপন
চেনা সুর দিয়েই তৈরি হয়েছে
নতুন গানের গঠন।

মন কষাকষি


আমার ভাবনাগুলো উড়ে যেতে যায়
চিন্তার সীমা ছাড়িয়ে, 
পারিনা আমি ধরতে তাদের
চেষ্টা করেও হাত বাড়িয়ে।
এই নিয়ে হয় প্রিয়ার সাথে
মন কষাকষি আমার,
কারণ সে বলে আমার মনের
মালিকানা নাকি তার।
অথচ সে কিন্তু নিজের বেলায়
অত্যধিক সচেতন,
প্রবেশ করা তো দূরের কথা
ছুঁতেও দেয়না মন।

মন কষাকষি


আমার ভাবনাগুলো উড়ে যেতে যায়
চিন্তার সীমা ছাড়িয়ে, 
পারিনা আমি ধরতে তাদের
চেষ্টা করেও হাত বাড়িয়ে।
এই নিয়ে হয় প্রিয়ার সাথে
মন কষাকষি আমার,
কারণ সে বলে আমার মনের
মালিকানা নাকি তার।
অথচ সে কিন্তু নিজের বেলায়
অত্যধিক সচেতন,
প্রবেশ করা তো দূরের কথা
ছুঁতেও দেয়না মন।

অলীক ভাবনা


আমি পথভ্রান্ত পথিকের কাছে
জানতে চাইব ঠিকানা, 
দগ্ধ হলেও অন্তরে অন্তরে
গেঁথে নেব সব নিশানা।
নিশানাগুলো হবে
কিছু অলীক কিছু বা বাস্তব,
ভালবাসা কিন্তু হলেও অলীক
বাস্তবে করব তার অনুভব।
তার কাছে অতীতকে ভুলে
ভবিষ্যতকে চাইব জানতে,
এমন কোন উপায় আছে কি
পৃথিবীর কোন প্রান্তে?
হয়ত বা থাকলেও তা হবে
কিছুটা অলীক কিছুটা বাস্তব
যার মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় ভাবব আমি
অসম্ভবও হবে কখনো সম্ভব।

আমার আকাঙ্ক্ষা


যে ফুল ফোটে নিত্য বাগানে
করি না তারে আদর, 
যারে পেতে গেলে যেতে হয় বনে
তারই বুঝি কদর।
যে আকাশ ঝুঁকে রোজ নেমে আসে
শুভ্র মেঘের বেশে,
তারে ছেড়ে আমি নীলাকাশ চাই
অচিনপুরের দেশে।
এমনই আমার বাসনা সমূহ
পাই না যারে তারে চাই,
অমূল্য রত্ন চক্ষের সম্মুখে
উপলব্ধ হলেও ফিরাই।

বৃক্ষের পরার্থপরতা


দুঃখের কথাগুলো
যেই বললেম নদীকে ,
ফোঁস করে উঠে ঢেউ তুলে সে
চলে গেল ভিন্ন দিকে।
আমার অসীম কষ্টগুলো
মনে হল আকাশ বুঝেছিল,
কিন্তু সেও সাদা সাদা মেঘ হয়ে
বৃষ্টি না দিয়ে উড়ে গেল।
আর যা শুনেছিল
এক অশীতিপর বৃক্ষ অজ্ঞাতসারে,
ফুলের সৌরভ করে তাই সে
বিলিয়ে দিল সবারে।

গ্রহণের অভিশাপ


পাব না যারে জীবনে তারে
যদি বা ভালবাসি, 
সুখের বদলে কপালে লেখা
থাকবে দুঃখের রাশি।
পাচ্ছি যারে জীবনে তারে
যদি না করি গ্রহণ
সুখ এলেও ছায়ায় ঢাকবে
দুঃখ কষ্টের গ্রহণ।

তোমার উদারতা


আমি কৃপণ অতি কৃপণ
ভাবনাগুলো পারিনা উড়িয়ে দিতে, 
তুমি সজ্জন অতি সজ্জন
মুখিয়ে থাকো ভালবাসা পেতে।
আমার চোখে মেঘ আসলেও
নামে না অশ্রুর বাঁধভাঙা ঢল,
আর তাই না দেখেই তোমার চক্ষু
অজানতেই ওঠে করে ছলছল।
আমি ভাবি ভালবাসা দিলে
প্রতিদানে কিছু অবশ্যই পাব
তুমি কিছু পাওয়ার আগেই
দেওয়ার কথা নিশ্চিত ভাব।

মধ্য শরতে বৃষ্টি


টাপুর টুপুর বৃষ্টি পড়ে
মনে হয় না এ শরতের মাস, 
নদীর ধারে কাঁদতে কাঁদতে
কেমন যেন ঝিমোচ্ছে কাশ।
চাঁদ উঠল না কোজাগরীতে
মেঘে ঢেকেছে সারাটা আকাশ,
বৃষ্টির বেগ ক্রমশঃ বাড়িয়ে
বয়েই চলছে ঠাণ্ডা বাতাস।
এ যেন কোণ শরতকাল নয়
সোনালি রোদের নেইকো বাহার,
থরে থরে সৌন্দর্য নিয়ে
উপস্থত হয়নি শিউলিও তার।

হৃদয়ের ঘরে চুরি


কোন এক নিশুতি রাতে
চুরি হয়েছিল আমার ঘরে, 
চোর যে আমার আপন কেউ
সে কথা আমি বলি বা কারে।
সে যে নিয়েছিল সর্বস্ব আমার
আজও সে কথা করে অস্বীকার,
আমারও হয়েছে মতিভ্রম
হাতড়ে মরি বন্ধ দুয়ার।
এখন ভীষণ মন কষাকষি
কে আগে নিঃস্ব করেছি কারে,
যদিও হয়েছি দুজনেই সমৃদ্ধ
এ কথা জানাই অতি চুপিসারে।

শরতের অতিথি


আর ফুটছে না কদম বকুল
চলার পথে রাস্তার ধারে, 
এখন ফুটছে শিউলির দল
গাছের পরে থরে থরে।
আর ঢাকছে না ইন্দু এখন
কৃষ্ণকালো মেঘের তলে,
ক্বচিৎ কদাচিৎ শুভ্র মেঘ
ভেজাচ্ছে ছিটেফোঁটা জলে।
এখন শুধু কাশের দল
হাসছে নদীর কিনার ধরে,
ঢেউগুলো তার হয়েছে ক্ষীণ
বইছে না আর তেমন জোরে।

শারদীয় বসন্ত


আমার কণ্ঠে ঝরে বসন্তের সুর
যদিও এখন শরতকাল, 
শিউলি ফুলের বৃন্তগুলো
লজ্জায় রেঙে হয়েছে লাল।
কৃষ্ণচূড়া দর্শন দেবে
যদিও আরও ক’মাস পরে,
অধৈর্য হয়ে উঠেছে চিত্ত
মন টেকেনা আর যে ঘরে।
কাশফুল তার নিজস্ব ভঙ্গিতে
নদীর পাড়ে বিদ্যমান,
সোনালি ধানে ঢেউ লেগেছে
মধুকর মধু করছে পান।
এমনও দিনে রই কি করে
ঘরের ভিতর বদ্ধ দ্বারে,
বুলবুলিতে গান ধরেছে
ধানের ক্ষেতে সুরে সুরে।

হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি


আমি আজও খুঁজি
সেই শান্ত দুপুর 
যখন শুনে
তোমার নূপুর
হারিয়ে যেতেম সহজে,
কিন্তু সে কি আর
আসে বারবার
তখন ছিল
জীবন সরল আর
এখন হয়েছে জটিল যে।
আমি আজও খুঁজি সেই
সন্ধ্যাবেলা
যখন করতাম
আমরা খেলা
আলো আঁধারে লুকোচুরি,
যদিও তখন
ছিল কৈশোর
তবুও তা মনে
থাকবে জীবনভর
বয়স বাড়লেও কয়েক কুড়ি।

মাটির কান্না

গভীর রাতের কালে,
কুহেলী আঁধার মূর্ছিত প্রায় জড়ায়ে ঘুমের জালে।
হাসপাতালের নিবিয়াছে বাহি; দমকা হাওয়ার ঘায়,
শত মুমূর্ষু রোগীর কাঁদন শিহরিছে বেদনায়।
কে তুমি চলেছ সাবধান পদে বয়স-বৃদ্ধা-নারী!
দুই পাশে তব রুগ্ন-ক্লিন্ন শুয়ে আছে সারি সারি।
কাহার পাখাটি জোরে চলিতেছে, বালিশ সরেছে কার,
বৃষ্টির হাওয়া লেগেকার গায়ে শিয়রে খুলিয়া দ্বার!
ব্যান্ডেজ কার খুলিয়া গিয়াছে, কাহার চাই যে জল,
স্বপন দেখিয়া কেঁদে ওঠে কেবা, আঁখি দুটি ছল ছল।
এ সব খবর লইতে লইতে চলিয়াছ একাকিনী,
দুঃখের কোন সান্ত্বনা তুমি, বেদনায় বিষাদিনী।
গভীর নিশীথে, অনেক ঊর্ধ্বে জ্বলিছে আকাশে তারা,
তোমার এ স্নেহ মমতার কাজ দেখিতে পাবে না তারা;
রাত-জাগা পাখি উড়িছে আকাশে, জানিবে না সন্ধান,
রাত জাগা ফুল ব্যস্ত বড়ই বাতাসে মিশাতে ঘ্রাণ।
তারা কেহ আজ জানিতে পাবে না, তাহাদেরি মত কেহ,
সারা নিশিজাগি বিলাইছে তার মায়েলী বুকের স্নেহ।
এই বিভাবরী বড়ই ক্লান্ত, বড়ই স্তব্ধতম
উতলা বাতাস জড়াইয়া কাঁদে আঁধিয়ার নির্মম।
মৃত্যু চলেছে এলায়িত কেশে ভয়াল বদন ঢাকি,
পরখ করিয়া কারে নিয়ে যাবে, কারে সে যাইবে রাখি।
মহামরণের প্রতীক্ষাতুর রোগীদের মাঝখানে,
মহীয়সী তুমি জননী মুরতি আসিলে কি সন্ধানে;
জীবন মৃত্যু মহা-রহস্য তুমি কি যাইবে খুলি,
ধরণীর কোন গোপন কুহেলী আজিকে লইবে তুলি।
যে বৃদ্ধ কাল সাক্ষ্য হইয়া আছে মানুষের সাথে,
তুমি কি তাহার বৃদ্ধা সাথিনী আসিয়াছ আজ রাতে?
নিখিল নরের আদিম জননী আজিকে তোমার বেশে,
রুগ্ন তাহার সন্তানদেরে দেখিয়া নিতেছ এসে।
নিরালা আমার শয্যার পাশে তোমার আঁচল-ছায়,
স্তব হয়ে আজ জড়ায়ে রহিতে বড় মোর সাধ য

ধামরাই রথ

ধামরাই রথ, কোন অতীতের বৃদ্ধ সুত্রধর,

কতকাল ধরে গড়েছিল এরে করি অতি মনোহর।
সূক্ষ্ম হাতের বাটালি ধরিয়া কঠিন কাঠেরে কাটি,
কত পরী আর লতাপাতা ফুল গড়েছিল পরিপাটি।
রথের সামনে যুগল অশ্ব, সেই কত কাল হতে,
ছুটিয়া চলেছে আজিও তাহারা আসে নাই কোন মতে।

তারপর এলো নিপুণ পটুয়া, সূক্ষ্ম তুলির ঘায়,
স্বর্গ হতে কত দেবদেবী আনিয়া রথের গায়।
রঙের রেখার মায়ায় বাঁধিয়া চির জনমের তরে,
মহা সান্ত্বনা গড়িয়া রেখেছে ভঙ্গুর ধরা পরে।
কৃষ্ণ চলেছে মথুরার পথে, গোপীরা রথের তলে,
পড়িয়া কহিছে, যেওনা বন্ধু মোদের ছাড়িয়া চলে।
অভাগিনী রাধা, আহা তার ব্যথা যুগ যুগ পার হয়ে,
অঝোরে ঝরিছে গ্রাম্য পোটোর কয়েকটি রেখা লয়ে।
সীতারে হরিয়া নেছে দশানন, নারীর নির্যাতন
সারা দেশ ভরি হৃদয়ে হৃদয়ে জ্বালায়েছে হুতাশন।
রাম-লক্ষ্মণ সুগ্রীব আর নর বানরের দল,
দশমুন্ড সে রাবণে বধিয়া বহালো লহুর ঢল।
বস্ত্র হরণে দ্রৌপদী কাঁদে, এ অপমানের দাদ,
লইবারে সাজে দেশে দেশে বীর করিয়া ভীষণ নাদ।
কত বীর দিল আত্ম-আহুতী, ভগ্ন শঙ্খ শাঁখা।
বোঝায় বোঝায় পড়িয়া কত যে নারীর বিলাপ মাথা।
শ্মশান ঘাটা যে রহিয়া রহিয়া মায়েদের ক্রদনে,
শিখায় শিখায় জ্বলিছে নির্বিছে নব নব ইন্ধনে।
একদল মরে, আর দল পড়ে ঝাপায়ে শক্র মাঝে,
আকাশ ধরণী সাজিল সে-দিন রক্তাশ্বর সাজে।
তারপর সেই দুর্যধনের সবংশ নিধনিয়া,
ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠিত যে হলো সারা দেশ নিয়া।
এই ছবিগুলি রথের কাঠের লিলায়িত রেখা হতে,
কালে কালে তাহা রুপায়িত হতো জীবন দানের ব্রতে।
নারীরা জানিত, এমনি ছেলেরা সাজিবে যুদ্ধ সাজে,
নারী-নির্যাতন-কারীদের মহানিধনের কাজে।
বছরে দু-বার বসিত হেথায় রথ-যাত্রার মেলা,
কত যে দোকান পসারী আসিত কত সার্কাস খেলা।
কোথাও গাজীর গানের আসরে খোলের মধুর সুরে।
কত যে বাদশা বাদশাজাদীরা হেথায় যাইত ঘুরে।
শ্রোতাদের মনে জাগায়ে তুলিত কত মহিমার কথা,
কত আদর্শ নীতির ন্যায়ের গাঁথিয়া সুরের লতা।
পুতুলের মত ছেলেরা মেয়েরা পুতুল লইয়া হাতে।
খুশীর কুসুম ছড়ায়ে চলিত বাপ ভাইদের সাথে।
কোন যাদুকর গড়েছিল রথ তুচ্ছ কি কাঠ নিয়া,
কি মায়া তাহাতে মেখে দিয়েছিল নিজ হৃদি নিঙাড়িয়া।
তাহারি মায়ায় বছর বছর কোটী কোটী লোক আসি,
রথের সামনে দোলায়ে যাইত প্রীতির প্রদীপ হাসি।
পাকিস্তানের রক্ষাকারীরা পরিয়া নীতির বেশ,
এই রথখানি আগুনে পোড়ায়ে করিল ভস্মশেষ।
শিল্পী হাতের মহা সান্ত্বনা যুগের যুগের তরে,
একটি নিমেষে শেষ করে গেল এসে কোন বর্বরে।

গীতারা কোথায় গেলো

গীতারা কোথায় গেলো

আহা সেই পুতুলের মতো রাঙা টুকটুকে মেয়ে।
দেখলে তাহারে মায়া মমতার ধারা বয়ে যায়
সারা বুকখানি ছেয়ে,
আদরি তাহারে কথা না ফুরায়
কথার কুসুম আকাশে বাতাসে উঠে বেয়ে,
দেখলে তাহারে ছাড়ায় ছড়ায় ছড়ায় যে মন
গড়ায় ধরণী ছেয়ে।
ওদের গ্রামের চারিদিক বেড়ি ঘিরেছে দস্যুদল,
ঘরে ঘরে তারা আগুন জ্বালায়ে ফুকারে অগ্নিকল।
সেই কচি মেয়ে কোলে তুলে নিতে কোল যে জুড়িয়ে যেত,
কে মারিল তারে ? মানুষ কি পারে নিষ্ঠুর হতে এত।
অফুট কুসুম কে দলেছে পায়ে? কথার সে বুলবুলি,
কোন নিষ্ঠুর বধেছে তাহারে গলায় আঙ্গুল তুলি ?
সে বন-হরিণী নিষ্ঠুর হতে পালাবার লাগি
হেথায় হোথায় কত না ঘুরেছে হায়।
সারা গাঁও করি উথাল পাথাল বাণ-বিদ্ধ যে করিয়াছে ব্যাধ তায়।
আহারে আমার ছোট গীতামণি,
তোর তরে আজ কেঁদে ফিরি সবখানে,
মোর ক্রদন নিঠুর দেশের সীমানা পেরিয়ে
পারিবে কি যেতে কোন দরদীয় কানে।
- See more at: http://www.ebanglalibrary.com/jasimuddin/116#more-116

জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশ (জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯, বরিশাল - মৃত্যু: ২২ অক্টোবর, ১৯৫৪, বঙ্গাব্দ: ৬ ফাল্গুন, ১৩০৫ - ৫ কার্তিক, ১৩৬১) বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে যখন তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কবিতে পরিণত হয়েছেন। তিনি প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন। তবে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে অকাল মৃত্যুর আগে তিনি নিভৃতে ১৪টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প রচনা গ্রন্থ করেছেন যার একটিও তিনি জীবদ্দশায় প্রকাশ করেননি। তাঁর জীবন কেটেছে চরম দারিদ্রের মধ্যে। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধকাল অনপনেয়ভাবে বাংলা কবিতায় তাঁর প্রভাব মুদ্রিত হয়েছে। রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসাবে তিনি সর্বসাধারণ্যে স্বীকৃত

হায় চিল

জীবনানন্দ দাশ

হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে! 
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে।
পৃথিবীর রাঙ্গা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;
আবার তাহারে কেন ডেকে আনো?
কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!
হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!

তোমাকে

একদিন মনে হতো জলের মতন তুমি।
সকালবেলার রোদে তোমার মুখের থেকে বিভা–
অথবা দুপুরবেলা — বিকেলের আসন্ন আলোয়–
চেয়ে আছে — চলে যায় — জলের প্রতিভা।
মনে হতো তীরের উপরে বসে থেকে।
আবিষ্ট পুকুর থেকে সিঙাড়ার ফল
কেউ কেউ তুলে নিয়ে চলে গেলে — নীচে
তোমার মুখের মতন অবিকল।
নির্জন জলের রঙ তাকায়ে রয়েছে;
স্থানান্তরিত হয়ে দিবসের আলোর ভিতরে
নিজের মুখের ঠান্ডা জলরেখা নিয়ে
পুনরায় শ্যাম পরগাছা সৃষ্টি করে;
এক পৃথিবীর রক্ত নিপতিত হয়ে গেছে জেনে
এক পৃথিবীর আলো সব দিকে নিভে যায় বলে
রঙিন সাপকে তার বুকের ভিতরে টেনে নেয়;
অপরাহে আকাশের রং ফিকে হলে।
তোমার বুকের পরে আমাদের পৃথিবীর অমোঘ সকাল;
তোমার বুকের পরে আমাদের বিকেলের রক্তিল বিন্যাস;
তোমার বুকের পরে আমাদের পৃথিবীর রাত;
নদীর সাপিনী, লতা, বিলীন বিশ্বাস।

সে

জীবনানন্দ দাশ

আমাকে সে নিয়েছিলো ডেকে;
বলেছিলোঃ 'এ নদীর জল 
তোমার চোখের মত ম্লান বেতফল;
সব ক্লান্তি রক্তের থেকে
স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি;
এই নদী তুমি।'
'এর নাম ধানসিঁড়ি বুঝি?'
মাছরাঙাদের বললাম;
গভীর মেয়েটি এসে দিয়েছিলো নাম।
আজো আমি মেয়েটিকে খুঁজি;
জলের অপার সিঁড়ি বেয়ে
কোথায় যে চলে গেছে মেয়ে।
সময়ের অবিরল শাদা আর কালো
বনানীর বুক থেকে এসে
মাছ আর মন আর মাছরাঙাদের ভালোবেসে
ঢের আগে নারী এক - তবু চোখ ঝলসানো আলো
ভালোবেসে ষোলো আনা নাগরিক যদি
না হয়ে বরং হতো ধানসিঁড়ি নদী।

আকাশলীনা

জীবনানন্দ দাশ

সুরঞ্জনা, অইখানে যেয়োনাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে; 
ফিরে এসো সুরঞ্জনা :
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে - আরও দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।
কী কথা তাহার সাথে? - তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ :
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।
সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস :
বাতাসের ওপারে বাতাস -
আকাশের ওপারে আকাশ।

হৃদয়ে প্রেমের দিন

জীবনানন্দ দাশ
হৃদয়ে প্রেমের দিন কখন যে শেষ হয় — চিতা শুধু পড়ে থাকে তার,
আমরা জানি না তাহা; — মনে হয় জীবনে যা আছে আজো তাই শালিধান 
রূপশালি ধান তাহা… রূপ, প্রেম… এই ভাবি… খোসার মতন নষ্ট ম্লান
একদিন তাহাদের অসারতা ধরা পড়ে, — যখন সবুজ অন্ধকার,
নরম রাত্রির দেশ নদীর জলের গন্ধ কোন এক নবীনাগতার
মুখখানা নিয়ে আসে — মনে হয় কোনোদিন পৃথিবীতে প্রেমের আহ্বান
এমন গভীর করে পেয়েছি কি? প্রেম যে নক্ষত্র আর নক্ষত্রের গান,
প্রাণ যে ব্যাকুল রাত্রি প্রান্তরের গাঢ় নীল অমাবস্যায় –
চলে যায় আকাশের সেই দূর নক্ষত্রের লাল নীল শিখার সন্ধানে,
প্রাণ যে আঁধার রাত্রি আমার এ, — আর তুমি স্বাতীর মতন
রূপের বিচিত্র বাতি নিয়ে এলে, — তাই প্রেম ধুলায় কাঁটায় যেইখানে
মৃত হয়ে পড়ে ছিল পৃথিবীর শূণ্য পথে সে গভীর শিহরণ,
তুমি সখী, ডুবে যাবে মুহূর্তেই রোমহর্ষে — অনিবার অরুণের ম্লানে
জানি আমি; প্রেম যে তবুও প্রেম; স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে রবে, বাঁচিতে সে জানে।

বনলতা সেন

জীবনানন্দ দাশ

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে 
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন ।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, 'এতদিন কোথায় ছিলেন?'
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মত
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে - সব নদী - ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

বনের চাতক-মনের চাতক

 জীবনানন্দ দাশ

বনের চাতক বাঁধল বাসা মেঘের কিনারায়-
মনের চাতক হারিয়ে গেল দূরের দুরাশায়! 
ফুঁপিয়ে ওঠে কাতর আকাশ সেই হতাশার ক্ষোভে-
সে কোন্ বোঁটের ফুলের ঠোঁটের মিঠা মদের লোভে
বনের চাতক-মনের চাতক কাঁদছে অবেলায়!
পুবের হাওয়ায় হাপর জ্বলে, আগুনদানা ফাটে!
কোন্ ডাকিনীর বুকের চিতায় পচিম আকাশ টাটে!
বাদল-বৌয়ের চুমার মৌয়ের সোয়াদ চেয়ে চেয়ে
বনের চাতক-মনের চাতক চলছে আকাশ বেয়ে,
ঘাটের ভরা কলসি ও-কার কাঁদছে মাঠে মাঠে!
ওরে চাতক, বনের চাতক, আয় রে নেমে ধীরে
নিঝুম ছায়া-বৌরা যেথা ঘুমায় দীঘি ঘিরে,
"দে জল!" ব'লে ফোঁপাস কেন? মাটির কোলে জল
খবর-খোঁজা সোজা চোখের সোহাগে ছল্‌ছল্ !
মজিস নে রে আকাশ-মরুর মরীচিকার তীরে!
মনের চাতক, হতাশ উদাস পাখায় দিয়ে পাড়ি
কোথায় গেলি ঘরের কোণের কানাকানি ছাড়ি?
ননীর কলস আছে রে তার কাঁচা বুকের কাছে,
আতার ক্ষীরের মতো সোহাগ সেথায় ঘিরে আছে!
আয় রে ফিরে দানোয়-পাওয়া, আয় রে তাড়াতাড়ি।
বনের চাতক, মনের চাতক আসে না আর ফিরে,
কপোত-ব্যথা বাজায় মেঘের শকুনপাখা ঘিরে!
সে কোন্ ছুঁড়ির চুড়ি আকাশ-শুঁড়িখানায় বাজে!
চিনিমাখা ছায়ায় ঢাকা চুনীর ঠোঁটের মাঝে
লুকিয়ে আছে সে-কোন্ মধু মৌমাছিদের ভিড়ে!

বেদিয়া

 জীবনানন্দ দাশ

চুলিচালা সব ফেলেছে সে ভেঙে, পিঞ্জরহারা পাখি!
পিছুডাকে কভু আসে না ফিরিয়া, কে তারে আনিবে ডাকি? 
উদাস উধাও হাওয়ার মতন চকিতে যায় সে উড়ে,
গলাটি তাহার সেধেছে অবাধ নদী-ঝর্ণার সুরে;
নয় সে বান্দা রংমহলের, মোতিমহলের বাঁদী,
ঝোড়ো হাওয়া সে যে, গৃহপ্রাঙ্গণে কে তারে রাখিবে বাঁধি!
কোন্ সুদূরের বেনামী পথের নিশানা নেছে সে চিনে,
ব্যর্থ ব্যথিত প্রান্তর তার চরণচিহ্ন বিনে!
যুগযুগান্ত কত কান্তার তার পানে আছে চেয়ে,
কবে সে আসিবে ঊষর ধূসর বালুকা-পথটি বেয়ে
তারই প্রতীক্ষা মেগে ব'সে আছে ব্যাকুল বিজন মরু!
দিকে দিকে কত নদী-নির্ঝর কত গিরিচূড়া-তরু
ঐ বাঞ্ছিত বন্ধুর তরে আসন রেখেছে পেতে
কালো মৃত্তিকা ঝরা কুসুমের বন্দনা-মালা গেঁথে
ছড়ায়ে পড়িছে দিগ্‌দিগন্তে ক্ষ্যাপা পথিকের লাগি!
বাবলা বনের মৃদুল গন্ধে বন্ধুর দেখা মাগি
লুটায়ে রয়েছে কোথা সীমান্তে শরৎ উষার শ্বাস!
ঘুঘু-হরিয়াল-ডাহুক-শালিখ-গাঙচিল-বুনোহাঁস
নিবিড় কাননে তটিনীর কূলে ডেকে যায় ফিরে ফিরে
বহু পুরাতন পরিচিত সেই সঙ্গী আসিল কি রে!
তারই লাগি ভায় ইন্দ্রধনুক নিবিড় মেঘের কূলে,
তারই লাগি আসে জোনাকি নামিয়া গিরিকন্দরমূলে।
ঝিনুক-নুড়ির অঞ্জলি ল'য়ে কলরব ক'রে ছুটে
নাচিয়া আসিছে অগাধ সিন্ধু তারই দুটি করপুটে।
তারই লাগি কোথা বালুপথে দেখা দেয় হীরকের কোণা,
তাহারই লাগিয়া উজানী নদীর ঢেউয়ে ভেসে আসে সোনা!
চকিতে পরশপাথর কুড়ায়ে বালকের মতো হেসে
ছুড়ে ফেলে দেয় উদাসী বেদিয়া কোন্ সে নিরুদ্দেশে!
যত্ন করিয়া পালক কুড়ায়, কানে গোঁজে বনফুল,
চাহে না রতন-মণিমঞ্জুষা হীরে-মাণিকের দুল,
-তার চেয়ে ভালো অমল উষার কনক-রোদের সীঁথি,
তার চেয়ে ভালো আলো-ঝল্মল্ শীতল শিশিরবীথি,
তার চেয়ে ভালো সুদূর গিরির গোধূলি-রঙিন জটা,
তার চেয়ে ভালো বেদিয়া বালার ক্ষিপ্র হাসির ছটা!
কী ভাষা বলে সে, কী বাণী জানায়, কিসের বারতা বহে!
মনে হয় যেন তারই তরে তবু দুটি কান পেতে রহে
আকাশ-বাতাস-আলোক-আঁধার মৌন স্বপ্নভরে,
মনে হয় যেন নিখিল বিশ্ব কোল পেতে তার তরে!

আবার আসিব ফিরে

জীবনানন্দ দাশ

আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে - এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় - হয়তো বা শাঁখচিল শালিকের বেশে, 
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিঁকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়।
হয়তো বা হাঁস হবো - কিশোরীর - ঘুঙুর রহিবে লাল পায়
সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে।
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলঙ্গীর ঢেউ এ ভেজা বাংলারি সবুজ করুণ ডাঙ্গায়।
হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে।
হয়তো শুনিবে এক লক্ষীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে।
হয়তো খৈয়ের ধান সরাতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে।
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙ্গা বায় - রাঙ্গা মেঘে সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে,
দেখিবে ধবল বক; আমারে পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে।

আবোল তাবোল

আয়রে ভোলা খেয়াল‐খোলা 
স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়, 
আয়রে পাগল আবোল তাবোল
মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়।
আয় যেখানে ক্ষ্যাপার গানে
নাইকো মানে নাইকো সুর,
আয়রে যেথায় উধাও হাওয়ায়
মন ভেসে যায় কোন সুদূর।...
আয় ক্ষ্যাপা‐মন ঘুচিয়ে বাঁধন
জাগিয়ে নাচন তাধিন্ ধিন্,
আয় বেয়াড়া সৃষ্টিছাড়া
নিয়মহারা হিসাবহীন।
আজগুবি চাল বেঠিক বেতাল
মাতবি মাতাল রঙ্গেতে—
আয়রে তবে ভুলের ভবে
অসম্ভবের ছন্দেতে॥

রেড সিগনাল

দিন গেল যাক না
খাবে কতো খাক না
আর ক'টা দিন তুই
চুপচাপ থাক না।
ক'দিন আর মস্তির!
কেনো এতো অস্থির
হতে দে যাই হোক
দম নে সস্তির।
সময় ঘনালে আর যায় নাতো থাকা
মরার সময় গজে পিঁপড়ার পাখা।

বেদনার দিঘী

বেদনার দিঘী 

আমার একটা বেদনার দিঘী ছিল 
দেখতে দেখতে ওটা সাগর হয়ে গেল।
শুনেছি তখন আমার দুই বছর-
অহিংসার সাধক আমার বাবা পুড়ে গেল বন্ধুর হিংসাযজ্ঞে,
জীবনে পায়নি ‘বুদ্ধ-শান্তি’, মরণে পেল
আমার বেদনার ছোট্ট দিঘীটাও সেইদিনই তৈরী হল।
তারপর মা, আমার চিরবঞ্চিত-শৈশবের সর্বত্রাতা বিপদনাশিনী মা,
স্বামীর লাল চিতা নিবে গেছে ঠিকই,
কিন্তু শাড়ি বেয়ে সাদা আগুন লেগে গেছে সমস্ত সত্ত্বায়
দশদিক ভরে গেছে পাহাড়ের মত অনড় শ্বেত-আগুনে
পড়শি পুরুষের ছোঁক-ছোঁক, স্বামীর ভিটায় আত্মীয়দের চোখ,
অর্ধাহারে শিশুপুত্র - কতবার যে সতীদাহ হল
মাথার আর কী দোষ – এভাবে কতদিন ঠিক থাকে?
তাও দিন কাটছিল,
কিন্তু যেদিন মা সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেল
আমার বেদনার দিঘীটা একলাফে নদীর রূপ নিল।
দেখতে দেখতে দেড় যুগ হতে চলল-
প্রতি বছরের মত চৈত্রসংক্রান্তিতে পুকুরে নেমে ডাব খাব, হঠাৎ -
ডাবের জলে একটা ছায়া – একটা জলরঙা মেয়ের ঘোর লাগানো ছায়া
ও এল, জলের মতই কলকল উচ্ছ্বল – আমার নিবু এল,
কিছুই না-পাওয়া জীবনে এই প্রথম বুঝলাম - পাওয়া কাকে বলে
টের পেলাম অলির আনন্দ
কদিনের জন্য বেদনার নদীটা আমার শুকিয়েই গেল ।
যাবার সময় জোড়া শালিক সাক্ষী করে নিবু বলে গেল-
আসছে চৈত্রসংক্রান্তিতে তোমাদের সিঁদুরে আমগাছতলায় সিঁদুর পড়ব
কণ্ঠীবদলের পালা হবে।
অলির আনন্দ শেষে শুরু হল চাতকের আকাশ চাওয়া
হায়, একে একে কেঁটে গেল আঠারোটি সংক্রান্তি-
সিঁদুরে আমগাছে সিঁদুরে আম ধরে
সিঁদুর পড়া কেউ আসে না – আমার একলা ঘরে।
এই আঠারো বছরে আমার বেদনার নদীটা আঠারোটি সাগর হয়ে গেছে। 

জবা

 সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

আমারে লইয়া সুখী হও তুমি ওগো দেবী শবাসনা,
আর খুঁজিও না মানব-শোনিত, আর তুমি খুঁজিও না। 
আর মানুষের হৃত্ পিণ্ডটা নিওনা খড়গে ছিঁড়ে,
হাহকার তুমি তুলো না গো আর সুখের নিভৃত নীড়ে।
এই দেখ আমি উঠেছি ফুটিয়া উজলি পুষ্পসভা,
ব্যথিত ধরার হৃত্ পিণ্ডটি আমি যে রক্তজবা।
তোমার চরণে নিবেদিত আমি, আমি যে তোমার বলি,
দৃষ্টি-ভোগের রাঙ্গা খর্পরে রক্ত কলিজা-কলি।
আমারে লইয়া খুশি হও ওগো, নম দেবি নম নম,
ধরার অর্ঘ্য করিয়া গ্রহণ, ধরার শিশুরে ক্ষম।
মোর প্রিয়া হবে এস রানী
দেব খোপায় তাঁরার ফুল
কর্ণে দোলাবো তৃতীয়া তিথি
চৈতী চাঁদের দুল ।
কন্ঠে তোমার পরাব বালিকা
হংস সারির দুলানো মালিকা
বিজলি জরিণ ফিতায় বাধিব
মেঘরঙ এলো চুল ।
জোছনার সাথে চন্দন দিয়ে
মাখাব তোমার গায়ে
রামধনু হতে লাল রং ছানি
আলতা পরাব পায় ।
আমার গানের সাতসুর দিয়া
তোমার বাসর রচিব ও প্রিয়া
তোমারে ঘিরিয়া গাহিবে
আমার কবিতার বুলবুল ।

‘ভালোবাসার সংজ্ঞা’’

রফিক আজাদ

ভালোবাসা মানে দুজনের পাগলামি,
পরস্পরকে হৃদয়ের কাছে টানা;
ভালোবাসা মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়া,
বিরহ-বালুতে খালিপায়ে হাঁটাহাঁটি;
ভালোবাসা মানে একে অপরের প্রতি খুব করে ঝুঁকে থাকা;
ভালোবাসা মানে ব্যাপক বৃষ্টি, বৃষ্টির একটানা
ভিতরে-বাহিরে দুজনের হেঁটে যাওয়া;
ভালোবাসা মানে ঠাণ্ডা কফির
পেয়ালা সামনে
অবিরল কথা বলা;
ভালোবাসা মানে শেষ হয়ে-
যাওয়া কথার পরেও
মুখোমুখি বসে থাকা।

জাগো মুসলিম জাগো "

জাগো মুসলিম জেগে ওঠো
আর থেকোনা ঘুমে,
ইসলামের আজ দুর্দিন তাই
আর থেকো না রুমে ।
গর্জে ওঠো সবাই এবার
উড়াও দিনের নিশান,
ভয় করোনা বিধর্মীদের
থাকতে দেহে প্রাণ ।
বিধর্মীরা ইসলাম ধংসের
করছে পাঁয়তারা,
মুসলিম নামের লেবাছ পরা
মুসলমানদের দ্বারা ।
তাদের শক্তি যতই বড় হোক
ইসলামের থেকে নয় ,
যুগে যুগে বীজিত মুসলিম
তাই করুনা ভয় ।
দ্বীনের আলো ছড়িয়ে দাও
সকল লোকের মাঝে ,
তারা যেন না যাই ভুলে
সকল কাজে ।
যে কাজেতে তিনি মোদের
পেরন করলেন ভবে ,
সে কাজ যেন সবার আগে
করি মোরা সবে ।

পালের নাও

জসীমউদ্দীন

পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও-
ঘরে আছে ছোট বোনটি তারে নিয়ে যাও।
কপিল-সারি গাইয়ের দুধ যেয়ো পান করে’
কৌটা ভরি সিঁদুর দেব কপালটি ভরে’!
গুয়ার গায়ে ফুল চন্দন দেব ঘসে’ ঘসে’,
মামা-বাড়ীর বলব কথা শুনো বসে বসে!
কে যাওরে পাল ভরে’ কোন্ দেশে ঘর
পাছা নায়ে বসে আছে কোন্ সওদাগর?
কোন্ দেশে কোন্ গাঁয়ে হিরে ফুল ঝরে।
কোন্ দেশে হিরামন পাখী বাস করে!
কোন্ দেশে রাজ-কনে খালি ঘুম যায়,
ঘুম যায় আর হাসে হিম্-সিম্ বায় |
সেই দেশে যাব আমি কিছু নাহি চাই,
ছোট মোর বোনটিরে যদি সাথে পাই!
পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও,
তোমার যে পাল নাচে ফুলঝুরি বাও।
তোমার যে না’র ছই আবের ঢাকনী
ঝলমল জ্বলিতেছে সোনার বাঁধনী।
সোনার না বাঁধন্ রে তার গোড়ে গোড়ে
হিরামন পঙ্খীর লাল পাখা ওড়ে।
তারপর ওড়েরে ঝালরের ছাতি,
ঝলমল জলে জ্বলে রতনের বাতি।
এই নাও বেয়ে যায় কোন্ সদাগর,
কয়ে যাও—কয়ে যাও কোন্ দেশে ঘর?
পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও,
ঘরে আছে ছোট বোন্ তারে নিয়ে যাও,—
চেনা গাঙে সাত ধার করে গলাগলি,
সেথা বাস কেহেলার—লোকে গেছে বলি।
পারাপার দুই নদী—মাঝে বালুচর
সেইখানে বাস করে চাঁদ সওদাগর।
এ পারে ধুতুমের বাসা ও পারেতে টিয়া—
সেখানেতে যেও না রে নাও খানি নিয়া।
ভাইটাল গাঙ্ দোলে ভাটা গেঁয়ো সোতে,
হবে নারে নাও বাওয়া সেথা কোন মতে।

বৃষ্টির ছড়া


ফররুখ আহমদ

বৃষ্টি এল কাশ বনে
জাগল সাড়া ঘাস বনে,
বকের সারি কোথা রে
লুকিয়ে গেল বাঁশ বনে।
নদীতে নাই খেয়া যে,
ডাকল দূরে দেয়া যে,
কোন সে বনের আড়ালে
ফুটল আবার কেয়া যে।
গাঁয়ের নামটি হাটখোলা,
বিষটি বাদল দেয় দোলা,
রাখাল ছেলে মেঘ দেখে,
যায় দাঁড়িয়ে পথ-ভোলা।
মেঘের আঁধার মন টানে,
যায় সে ছুটে কোন খানে,
আউশ ধানের মাঠ ছেড়ে
আমন ধানের দেশ পানে।

অভিশাপ

অভিশাপ

যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে,
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে -
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
ছবি আমার বুকে বেঁধে
পাগল হয়ে কেঁদে কেঁদে
ফিরবে মরু কানন গিরি,
সাগর আকাশ বাতাস চিরি'
যেদিন আমায় খুঁজবে -
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

স্বপন ভেঙে নিশুত্ রাতে জাগবে হঠাৎ চমকে,
কাহার যেন চেনা-ছোওয়ায় উঠবে ও-বুক ছমকে, -
জাগবে হঠাৎ চমকে!
ভাববে বুঝি আমিই এসে
ব'সনু বুকের কোলটি ঘেঁষে,
ধরতে গিয়ে দেখবে যখন
শূন্য শয্যা! মিথ্যা স্বপন!
বেদনাতে চোখ বুজবে -
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
গাইতে ব'সে কন্ঠ ছিড়ে আসবে যখন কান্না,
ব'লবে সবাই - "সেই যে পথিক, তার শেখানো গান না?"
আসবে ভেঙে কান্না!
প'ড়বে মনে আমার সোহাগ,
কন্ঠে তোমার কাঁদবে বেহাগ!
প'ড়বে মনে অনেক ফাঁকি
অশ্রু-হারা কঠিন আঁখি
ঘন ঘন মুছবে -
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
আবার যেদিন শিউলি ফুটে ভ'রবে তোমার অঙ্গন,
তুলতে সে-ফুল গাঁথতে মালা কাঁপবে তোমার কঙ্কণ -
কাঁদবে কুটীর-অঙ্গন!
শিউলি ঢাকা মোর সমাধি
প'ড়বে মনে, উঠবে কাঁদি'!
বুকের মালা ক'রবে জ্বালা
চোখের জলে সেদিন বালা
মুখের হাসি ঘুচবে -
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

সুকুমার রায়

সুকুমার রায় (১৮৮৭ - ১৯২৩) একজন বাঙালি শিশুসাহিত্যিক ও ভারতীয় সাহিত্যে "ননসেন্স্ রাইমের" প্রবর্তক। তিনি একাধারে লেখক, ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, রম্যরচনাকার ও নাট্যকার। তিনি ছিলেন জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সন্তান এবং তাঁর পুত্র খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। তাঁর লেখা কবিতার বই আবোল তাবোল, গল্প হযবরল, গল্প সংকলন পাগলা দাশু, এবং নাটক চলচ্চিত্তচঞ্চরী বিশ্বসাহিত্যে সর্বযুগের সেরা "ননসেন্স" ধরণের ব্যঙ্গাত্মক শিশুসাহিত্যের অন্যতম বলে মনে করা হয়, কেবল অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড ইত্যাদি কয়েকটি মুষ্টিমেয় ক্লাসিক-ই যাদের সমকক্ষ। মৃত্যুর আশি বছর পরও তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম শিশুসাহিত্যিকদের একজন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ই মে কলকাতার এক ধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিঁনি ছিলেন অগ্রণী বাঙ্গালী কবি, ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, কন্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ্য সাহিত্যিক মনে করা হয়। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজী অনুবাদের জন্য তাঁকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। ইউরোপের বাহিরের প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসাবে তিনি বিশ্বে ব্যপক খ্যাতি লাভ করেন। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালের ৭ই অগাস্ট জোড়াসাঁকোর বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে মৃত্যুর সাত দিন আগে পর্যন্ত তিঁনি সৃষ্টিশীল ছিলেন।

যতীন্দ্রমোহন বাগচী

যতীন্দ্রমোহন বাগচী ১৮৭৮ সালের ২৭শে নভেম্বর নদিয়ার জমসেদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতার ডাফ কলেজ (বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজ) থেকে তিনি স্নাতক পাশ করেন। বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকীতে তিনি নিয়মিতি লেখালেখি করতেন। ১৯০৯ থেকে নিয়ে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত তিনি সাহিত্য পত্রিকা মানসী-র সম্পাদনায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯২১ থেকে নিয়ে বছরখানেক তিনি অপর এক সাহিত্য সাময়িকী যমুনা-র যুগ্ম সম্পাদক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৪৭-৪৮ সালে তিনি নজস্ব পত্রিকা পূর্বাচল চালু করেন এবং এর সম্পাদনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। তাঁর কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তাধারার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এছাড়াও তার কবিতায় প্রত্যন্ত বাংলার হাসি-কান্নার রূপ অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে ফুটে উঠেছে। ১৯৪৮ সালের ১লা ফেব্রুয়ারী যতীন্দ্রমোহন বাগচী মৃত্যুবরণ করেন।

ভালোবাসার সংজ্ঞা

__রফিক আজাদ

ভালোবাসা মানে দুজনের পাগলামি,
পরস্পরকে হৃদয়ের কাছে টানা;
ভালোবাসা মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়া,
বিরহ-বালুতে খালিপায়ে হাঁটাহাঁটি;
ভালোবাসা মানে একে অপরের প্রতি খুব করে ঝুঁকে থাকা;
ভালোবাসা মানে ব্যাপক বৃষ্টি, বৃষ্টির একটানা
ভিতরে-বাহিরে দুজনের হেঁটে যাওয়া;
ভালোবাসা মানে ঠাণ্ডা কফির
পেয়ালা সামনে
অবিরল কথা বলা;
ভালোবাসা মানে শেষ হয়ে-
যাওয়া কথার পরেও
মুখোমুখি বসে থাকা।

কাজলা দিদি

- যতীন্দ্রমোহন বাগচী
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই? 
পুকুর ধারে লেবুর তলে থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই-
মাগো আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?
সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো;-
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো?
খাবার খেতে আসি যখন, দিদি বলে ডাকি তখন,
ওঘর থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো?
আমি ডাকি তুমি কেন চুপটি করে থাকো?
বল মা দিদি কোথায় গেছে, আসবে আবার কবে?
কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল-বিয়ে হবে!
দিদির মত ফাঁকি দিয়ে, আমিও যদি লুকাই গিয়ে
তুমি তখন একলা ঘরে কেমন করে রবে,
আমিও নাই-দিদিও নাই- কেমন মজা হবে।
ভুঁই চাপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল,
মাড়াস্ নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল।
ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে বুলবুলিটি লুকিয়ে থাকে,
উড়িয়ে তুমি দিও না মা, ছিঁড়তে গিয়ে ফল,-
দিদি এসে শুনবে যখন, বলবি কি মা বল!
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই-
এমন সময় মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
লেবুর ধারে পুকুর পাড়ে ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোপে ঝাড়ে’
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, তাইতে জেগে রই
রাত্রি হলো মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও -
ঘরে আছে ছোট বোনটি তারে নিয়ে যাও।
কপিল-সারি গাইয়ের দুধ যেয়ো পান করে’
কৌটা ভরি সিঁদুর দেব কপালটি ভরে’!
গুয়ার গায়ে ফুল চন্দন দেব ঘসে’ ঘসে’,
মামা-বাড়ীর বলব কথা শুনো বসে বসে!
কে যাওরে পাল ভরে’ কোন্ দেশে ঘর
পাছা নায়ে বসে আছে কোন্ সওদাগর?
কোন্ দেশে কোন্ গাঁয়ে হিরে ফুল ঝরে।
কোন্ দেশে হিরামন পাখী বাস করে!
কোন্ দেশে রাজ-কনে খালি ঘুম যায়,
ঘুম যায় আর হাসে হিম্-সিম্ বায়।
সেই দেশে যাব আমি কিছু নাহি চাই,
ছোট মোর বোনটিরে যদি সাথে পাই!
পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও,
তোমার যে পাল নাচে ফুলঝুরি বাও।
তোমার যে না’র ছই আবের ঢাকনী
ঝলমল জ্বলিতেছে সোনার বাঁধনী।
সোনার না বাঁধন্ রে তার গোড়ে গোড়ে
হিরামন পঙ্খীর লাল পাখা ওড়ে।
তারপর ওড়েরে ঝালরের ছাতি,
ঝলমল জলে জ্বলে রতনের বাতি।
এই নাও বেয়ে যায় কোন্ সদাগর,
কয়ে যাও – কয়ে যাও কোন্ দেশে ঘর?
পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও,
ঘরে আছে ছোট বোন্ তারে নিয়ে যাও, -
চেনা গাঙে সাত ধার করে গলাগলি,
সেথা বাস কেহেলার – লোকে গেছে বলি।
পারাপার দুই নদী – মাঝে বালুচর
সেইখানে বাস করে চাঁদ সওদাগর।
এ পারে ধুতুমের বাসা ও পারেতে টিয়া -
সেখানেতে যেও না রে নাও খানি নিয়া।
ভাইটাল গাঙ্ দোলে ভাটা গেঁয়ো সোতে,
হবে নারে নাও বাওয়া সেথা কোন মতে।
হঠাৎ করে
গভীর রাতে
ফুটল তোমার
প্রেমের ফুল
সেই রাতেই
সেই ফুলের মাঝে
বসেই আমি
পেলাম কত সুখ ।
প্রেম দিয়ে কি প্রেম পাওয়া যায়
ভালবাসা দিয়ে সুখ।
প্রেমের ভিতর লুকিয়ে আছে
অসা‌‌ণ্তি নামক ভৃত ।
ভালবাসা দিয়ে কি
ভালবাসা পাওয়া যায় ।
প্রেম দিয়ে সুখ
ভালবাসার ভিতর লুকিয়ে আছে
অসা‌‌ণ্তি নামক ভৃত ।
অনদকার হৃদয়ের মাঝে
কে তুমি দিতে পার 
জালিয়ে মুমের আলো ।
সেই আলোতেই 
দেখে নেব আমি
কে মোরে ভাস গো ভাল ।
হার-মানা হার পরাব তোমার গলে-
দূরে রব কত আপন বলের ছলে।
জানি আমি জানি ভেসে যাবে আভিমান-
নিবিড় ব্যথায় ফাটিয়া পড়িবে প্রাণ,
শূন্য হিঁয়ার বাঁশিতে বাজিবে গান, 
পাষাণ তখন গলিবে নয়নজলে।
শতদলদল খুলে যাবে থরে থরে,
লুকানো রবে না মধু চিরদিন-তরে।
আকাশ জুড়িয়া চাহিবে কাহার আঁখি,
ঘরের বাহিরে নীরবে লইবে ডাকি,
কিছুই সেদিন কিছুই রবে না বাকি-
পরম মরণ লভিব চরনতলে।

ছিন্নমুকুল

- সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

সবচেয়ে যে ছোট পিড়ি খানি
সেখানি আর কেউ রাখেনা পেতে, 
ছোটথালায় হয় নাকো ভাতবাড়া
জল ভরে না ছোট্ট গেলাসেতে।
বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে যে ছোট
খাবার বেলা কেউ ডাকে না তাকে।
সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল,
তারই খাওয়া ঘুচেছে সব আগে।
সবচেয়ে যে অল্পে ছিল খুশি,
খুশি ছিল ঘেষাঘেষির ঘরে,
সেই গেছে হায়, হাওয়ার সঙ্গে মিশে,
দিয়ে গেছে জায়গা খালি করে।
ছেড়ে গেছে পুতুল, পুঁতির মালা,
ছেড়ে গেছে মায়ের কোলের দাবি।
ভয়ভরা সে ছিল যে সব চেয়ে
সেই খুলেছে আঁধার ঘরের চাবি।
হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে ওরে!
হারিয়ে গেছে 'বোল' বলা সেই বাঁশি
দুধে ধোওয়া কচি সে মুখখানি
আঁচল খুলে হঠাৎ স্রোতের জলে
ভেসে গেছে শিউলী ফুলের রাশি,
ঢুকেছে হায় শশ্মান ঘরের মাঝে
ঘর ছেড়ে হায় হৃদয় শশ্মানবাসী।
সবচেয়ে যে ছোট কাপড়গুলি
সেইগুলি কেউ দেয় না মেলে ছাদে,
যে শয্যাটি সবার চেয়ে ছোট,
আজকে সেটি শূন্য পড়ে কাঁদে।
সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল
সেই গিয়েছে সবার আগে সরে।
ছোট্ট যে জন ছিল রে সবচেয়ে,
সেই দিয়েছে সকল শূন্য করে।

তুমি আমার

তুমি আমার

তুমি আমার ভালবাসা
তুমি আমার প্রান
তুমি আমার হাসিকাননা
তুমি আমার জান ৷
তুমি আমার হৃদয় জুরে
একটু উদাস হওয়া
ইচেছ মত ভালবাসা
অনেক খানি পাওয়া
তুমি আমার ভুরের পাখি
নিশি জাগা চাঁদ
তাইতো জাগে হ্মনে হ্মণে
তোমাই পাওয়ার সাদ ।

সর্বহার

- কাজী নজরুল ইসলাম

ব্যথার সাতার-পানি-ঘেরা
চোরাবালির চর, 
ওরে পাগল! কে বেঁধেছিস
সেই চরে তোর ঘর?
শূন্যে তড়িৎ দেয় ইশারা,
হাট তুলে দে সর্বহারা,
মেঘ-জননীর অশ্রুধারা
ঝ’রছে মাথার’ পর,
দাঁড়িয়ে দূরে ডাকছে মাটি
দুলিয়ে তরু-কর।।
কন্যারা তোর বন্যাধারায়
কাঁদছে উতরোল,
ডাক দিয়েছে তাদের আজি
সাগর-মায়ের কোল।
নায়ের মাঝি! নায়ের মাঝি!
পাল তু’লে তুই দে রে আজি
তুরঙ্গ ঐ তুফান-তাজী
তরঙ্গে খায় দোল।
নায়ের মাঝি! আর কেন ভাই?
মায়ার নোঙর তোল্‌।
ভাঙন-ভরা ভাঙনে তোর
যায় রে বেলা যায়।
মাঝি রে! দেখ্‌ কুরঙ্গী তোর
কূলের পানে চায়।
যায় চ’লে ঐ সাথের সাথী
ঘনায় গহন শাঙন-রাতি
মাদুর-ভরা কাঁদন পাতি’
ঘুমুস্‌ নে আর, হায়!
ঐ কাঁদনের বাঁধন ছেঁড়া
এতই কি রে দায়?
হীরা-মানিক চাসনি ক’ তুই,
চাস্‌নি ত সাত ক্রোর,
একটি ক্ষুদ্র মৃৎপাত্র-
ভরা অভাব তোর,
চাইলি রে ঘুম শ্রানি–হরা
একটি ছিন্ন মাদুর-ভরা,
একটি প্রদীপ-আলো-করা
একটু-কুটীর-দোর।
আস্‌ল মৃত্যু আস্‌ল জরা,
আস্‌ল সিঁদেল-চোর।
মাঝি রে তোর নাও ভাসিয়ে
মাটির বুকে চল্‌!
শক্তমাটির ঘায়ে হউক
রক্ত পদতল।
প্রলয়-পথিক চ’ল্‌বি ফিরি
দ’লবি পাহাড়-কানন-গিরি!
হাঁকছে বাদল, ঘিরি’ ঘিরি’
নাচছে সিন্ধুজল।
চল্‌ রে জলের যাত্রী এবার
মাটির বুকে চল্‌ ।।

“মৃত্যুদন্ড”


_শামসুর রাহমান

বেকসুর আমি তবু আমাকেই মৃত্যুদন্ড দিলে!
কী করে তোমার কাছে অপরাধী, এখনও জানি না;
কস্মিনকালেও আমি শত্রুতা সাধিনি, শুধু বীনা,
অলৌকিক, প্রেমময়, বাজিয়েছি। সেই সুরে ছিলে
মিশে তুমি বসন্তের পাতার গভীরে, শান্ত ঝিলে,
শস্যক্ষেতে নীলিমায়। এই কি আমার অপরাধ?
আমার সর্বস্ব দিয়ে রাত্রিদিন একটি নিখাদ
প্রেমস্বপ্ন গড়ি, তা-ও ভেঙ্গে যায় কী কর্কশ
ঢিলে।
আমাকে পাঠালে নির্বাসনে, দিলে দন্ড ভয়ংকর।
তোমার সান্নিধ্য থেকে, অমন দৃষ্টির থেকে দূরে,
বহুদুরে চকিতে সরিয়ে দিলে- এই শাস্তি, বলো,
মৃতের চেয়েও বেশি, ঢের বেশি নয় কি কঠোর___?
তুমি কি দেখতে চাও সর্বদা আমার ছলছল চোখ?
চাও আমার হৃদয় খাক কীট কুরে-কুরে?