সীতারে হরিয়া নেছে দশানন, নারীর নির্যাতন সারা দেশ ভরি হৃদয়ে হৃদয়ে জ্বালায়েছে হুতাশন। রাম-লক্ষ্মণ সুগ্রীব আর নর বানরের দল, দশমুন্ড সে রাবণে বধিয়া বহালো লহুর ঢল। বস্ত্র হরণে দ্রৌপদী কাঁদে, এ অপমানের দাদ, লইবারে সাজে দেশে দেশে বীর করিয়া ভীষণ নাদ। কত বীর দিল আত্ম-আহুতী, ভগ্ন শঙ্খ শাঁখা। বোঝায় বোঝায় পড়িয়া কত যে নারীর বিলাপ মাথা। শ্মশান ঘাটা যে রহিয়া রহিয়া মায়েদের ক্রদনে, শিখায় শিখায় জ্বলিছে নির্বিছে নব নব ইন্ধনে।
একদল মরে, আর দল পড়ে ঝাপায়ে শক্র মাঝে, আকাশ ধরণী সাজিল সে-দিন রক্তাশ্বর সাজে। তারপর সেই দুর্যধনের সবংশ নিধনিয়া, ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠিত যে হলো সারা দেশ নিয়া। এই ছবিগুলি রথের কাঠের লিলায়িত রেখা হতে, কালে কালে তাহা রুপায়িত হতো জীবন দানের ব্রতে। নারীরা জানিত, এমনি ছেলেরা সাজিবে যুদ্ধ সাজে, নারী-নির্যাতন-কারীদের মহানিধনের কাজে।
বছরে দু-বার বসিত হেথায় রথ-যাত্রার মেলা, কত যে দোকান পসারী আসিত কত সার্কাস খেলা। কোথাও গাজীর গানের আসরে খোলের মধুর সুরে। কত যে বাদশা বাদশাজাদীরা হেথায় যাইত ঘুরে। শ্রোতাদের মনে জাগায়ে তুলিত কত মহিমার কথা, কত আদর্শ নীতির ন্যায়ের গাঁথিয়া সুরের লতা। পুতুলের মত ছেলেরা মেয়েরা পুতুল লইয়া হাতে। খুশীর কুসুম ছড়ায়ে চলিত বাপ ভাইদের সাথে। কোন যাদুকর গড়েছিল রথ তুচ্ছ কি কাঠ নিয়া, কি মায়া তাহাতে মেখে দিয়েছিল নিজ হৃদি নিঙাড়িয়া। তাহারি মায়ায় বছর বছর কোটী কোটী লোক আসি, রথের সামনে দোলায়ে যাইত প্রীতির প্রদীপ হাসি।
পাকিস্তানের রক্ষাকারীরা পরিয়া নীতির বেশ, এই রথখানি আগুনে পোড়ায়ে করিল ভস্মশেষ। শিল্পী হাতের মহা সান্ত্বনা যুগের যুগের তরে, একটি নিমেষে শেষ করে গেল এসে কোন বর্বরে।
আহা সেই পুতুলের মতো রাঙা টুকটুকে মেয়ে।
দেখলে তাহারে মায়া মমতার ধারা বয়ে যায়
সারা বুকখানি ছেয়ে,
আদরি তাহারে কথা না ফুরায়
কথার কুসুম আকাশে বাতাসে উঠে বেয়ে,
দেখলে তাহারে ছাড়ায় ছড়ায় ছড়ায় যে মন
গড়ায় ধরণী ছেয়ে।
ওদের গ্রামের চারিদিক বেড়ি ঘিরেছে দস্যুদল,
ঘরে ঘরে তারা আগুন জ্বালায়ে ফুকারে অগ্নিকল।
সেই কচি মেয়ে কোলে তুলে নিতে কোল যে জুড়িয়ে যেত,
কে মারিল তারে ? মানুষ কি পারে নিষ্ঠুর হতে এত।
অফুট কুসুম কে দলেছে পায়ে? কথার সে বুলবুলি,
কোন নিষ্ঠুর বধেছে তাহারে গলায় আঙ্গুল তুলি ?
সে বন-হরিণী নিষ্ঠুর হতে পালাবার লাগি
হেথায় হোথায় কত না ঘুরেছে হায়।
সারা গাঁও করি উথাল পাথাল বাণ-বিদ্ধ যে করিয়াছে ব্যাধ তায়।
আহারে আমার ছোট গীতামণি,
তোর তরে আজ কেঁদে ফিরি সবখানে,
মোর ক্রদন নিঠুর দেশের সীমানা পেরিয়ে
পারিবে কি যেতে কোন দরদীয় কানে।
- See more at: http://www.ebanglalibrary.com/jasimuddin/116#more-116
জীবনানন্দ দাশ (জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯, বরিশাল - মৃত্যু: ২২ অক্টোবর, ১৯৫৪, বঙ্গাব্দ: ৬ ফাল্গুন, ১৩০৫ - ৫ কার্তিক, ১৩৬১) বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে যখন তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কবিতে পরিণত হয়েছেন। তিনি প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন। তবে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে অকাল মৃত্যুর আগে তিনি নিভৃতে ১৪টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প রচনা গ্রন্থ করেছেন যার একটিও তিনি জীবদ্দশায় প্রকাশ করেননি। তাঁর জীবন কেটেছে চরম দারিদ্রের মধ্যে। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধকাল অনপনেয়ভাবে বাংলা কবিতায় তাঁর প্রভাব মুদ্রিত হয়েছে। রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসাবে তিনি সর্বসাধারণ্যে স্বীকৃত
হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে! তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে। পৃথিবীর রাঙ্গা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে; আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!
হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!
সকালবেলার রোদে তোমার মুখের থেকে বিভা– অথবা দুপুরবেলা — বিকেলের আসন্ন আলোয়– চেয়ে আছে — চলে যায় — জলের প্রতিভা। মনে হতো তীরের উপরে বসে থেকে। আবিষ্ট পুকুর থেকে সিঙাড়ার ফল কেউ কেউ তুলে নিয়ে চলে গেলে — নীচে তোমার মুখের মতন অবিকল। নির্জন জলের রঙ তাকায়ে রয়েছে; স্থানান্তরিত হয়ে দিবসের আলোর ভিতরে নিজের মুখের ঠান্ডা জলরেখা নিয়ে পুনরায় শ্যাম পরগাছা সৃষ্টি করে; এক পৃথিবীর রক্ত নিপতিত হয়ে গেছে জেনে এক পৃথিবীর আলো সব দিকে নিভে যায় বলে রঙিন সাপকে তার বুকের ভিতরে টেনে নেয়; অপরাহে আকাশের রং ফিকে হলে। তোমার বুকের পরে আমাদের পৃথিবীর অমোঘ সকাল; তোমার বুকের পরে আমাদের বিকেলের রক্তিল বিন্যাস; তোমার বুকের পরে আমাদের পৃথিবীর রাত; নদীর সাপিনী, লতা, বিলীন বিশ্বাস।
আমাকে সে নিয়েছিলো ডেকে; বলেছিলোঃ 'এ নদীর জল তোমার চোখের মত ম্লান বেতফল; সব ক্লান্তি রক্তের থেকে স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি; এই নদী তুমি।'
'এর নাম ধানসিঁড়ি বুঝি?' মাছরাঙাদের বললাম; গভীর মেয়েটি এসে দিয়েছিলো নাম। আজো আমি মেয়েটিকে খুঁজি; জলের অপার সিঁড়ি বেয়ে কোথায় যে চলে গেছে মেয়ে।
সময়ের অবিরল শাদা আর কালো বনানীর বুক থেকে এসে মাছ আর মন আর মাছরাঙাদের ভালোবেসে ঢের আগে নারী এক - তবু চোখ ঝলসানো আলো ভালোবেসে ষোলো আনা নাগরিক যদি না হয়ে বরং হতো ধানসিঁড়ি নদী।
হৃদয়ে প্রেমের দিন কখন যে শেষ হয় — চিতা শুধু পড়ে থাকে তার, আমরা জানি না তাহা; — মনে হয় জীবনে যা আছে আজো তাই শালিধান রূপশালি ধান তাহা… রূপ, প্রেম… এই ভাবি… খোসার মতন নষ্ট ম্লান একদিন তাহাদের অসারতা ধরা পড়ে, — যখন সবুজ অন্ধকার, নরম রাত্রির দেশ নদীর জলের গন্ধ কোন এক নবীনাগতার মুখখানা নিয়ে আসে — মনে হয় কোনোদিন পৃথিবীতে প্রেমের আহ্বান এমন গভীর করে পেয়েছি কি? প্রেম যে নক্ষত্র আর নক্ষত্রের গান, প্রাণ যে ব্যাকুল রাত্রি প্রান্তরের গাঢ় নীল অমাবস্যায় –
চলে যায় আকাশের সেই দূর নক্ষত্রের লাল নীল শিখার সন্ধানে, প্রাণ যে আঁধার রাত্রি আমার এ, — আর তুমি স্বাতীর মতন রূপের বিচিত্র বাতি নিয়ে এলে, — তাই প্রেম ধুলায় কাঁটায় যেইখানে মৃত হয়ে পড়ে ছিল পৃথিবীর শূণ্য পথে সে গভীর শিহরণ, তুমি সখী, ডুবে যাবে মুহূর্তেই রোমহর্ষে — অনিবার অরুণের ম্লানে জানি আমি; প্রেম যে তবুও প্রেম; স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে রবে, বাঁচিতে সে জানে।
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে; আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন, আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন ।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর, তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, 'এতদিন কোথায় ছিলেন?' পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মত সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল; পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল; সব পাখি ঘরে আসে - সব নদী - ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন; থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
বনের চাতক, মনের চাতক আসে না আর ফিরে,
কপোত-ব্যথা বাজায় মেঘের শকুনপাখা ঘিরে!
সে কোন্ ছুঁড়ির চুড়ি আকাশ-শুঁড়িখানায় বাজে!
চিনিমাখা ছায়ায় ঢাকা চুনীর ঠোঁটের মাঝে
লুকিয়ে আছে সে-কোন্ মধু মৌমাছিদের ভিড়ে!
চুলিচালা সব ফেলেছে সে ভেঙে, পিঞ্জরহারা পাখি!
পিছুডাকে কভু আসে না ফিরিয়া, কে তারে আনিবে ডাকি? উদাস উধাও হাওয়ার মতন চকিতে যায় সে উড়ে, গলাটি তাহার সেধেছে অবাধ নদী-ঝর্ণার সুরে; নয় সে বান্দা রংমহলের, মোতিমহলের বাঁদী, ঝোড়ো হাওয়া সে যে, গৃহপ্রাঙ্গণে কে তারে রাখিবে বাঁধি! কোন্ সুদূরের বেনামী পথের নিশানা নেছে সে চিনে, ব্যর্থ ব্যথিত প্রান্তর তার চরণচিহ্ন বিনে! যুগযুগান্ত কত কান্তার তার পানে আছে চেয়ে, কবে সে আসিবে ঊষর ধূসর বালুকা-পথটি বেয়ে তারই প্রতীক্ষা মেগে ব'সে আছে ব্যাকুল বিজন মরু! দিকে দিকে কত নদী-নির্ঝর কত গিরিচূড়া-তরু ঐ বাঞ্ছিত বন্ধুর তরে আসন রেখেছে পেতে কালো মৃত্তিকা ঝরা কুসুমের বন্দনা-মালা গেঁথে ছড়ায়ে পড়িছে দিগ্দিগন্তে ক্ষ্যাপা পথিকের লাগি! বাবলা বনের মৃদুল গন্ধে বন্ধুর দেখা মাগি লুটায়ে রয়েছে কোথা সীমান্তে শরৎ উষার শ্বাস! ঘুঘু-হরিয়াল-ডাহুক-শালিখ-গাঙচিল-বুনোহাঁস নিবিড় কাননে তটিনীর কূলে ডেকে যায় ফিরে ফিরে বহু পুরাতন পরিচিত সেই সঙ্গী আসিল কি রে! তারই লাগি ভায় ইন্দ্রধনুক নিবিড় মেঘের কূলে, তারই লাগি আসে জোনাকি নামিয়া গিরিকন্দরমূলে। ঝিনুক-নুড়ির অঞ্জলি ল'য়ে কলরব ক'রে ছুটে নাচিয়া আসিছে অগাধ সিন্ধু তারই দুটি করপুটে। তারই লাগি কোথা বালুপথে দেখা দেয় হীরকের কোণা, তাহারই লাগিয়া উজানী নদীর ঢেউয়ে ভেসে আসে সোনা! চকিতে পরশপাথর কুড়ায়ে বালকের মতো হেসে ছুড়ে ফেলে দেয় উদাসী বেদিয়া কোন্ সে নিরুদ্দেশে! যত্ন করিয়া পালক কুড়ায়, কানে গোঁজে বনফুল, চাহে না রতন-মণিমঞ্জুষা হীরে-মাণিকের দুল, -তার চেয়ে ভালো অমল উষার কনক-রোদের সীঁথি, তার চেয়ে ভালো আলো-ঝল্মল্ শীতল শিশিরবীথি, তার চেয়ে ভালো সুদূর গিরির গোধূলি-রঙিন জটা, তার চেয়ে ভালো বেদিয়া বালার ক্ষিপ্র হাসির ছটা! কী ভাষা বলে সে, কী বাণী জানায়, কিসের বারতা বহে! মনে হয় যেন তারই তরে তবু দুটি কান পেতে রহে আকাশ-বাতাস-আলোক-আঁধার মৌন স্বপ্নভরে, মনে হয় যেন নিখিল বিশ্ব কোল পেতে তার তরে!
আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে - এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় - হয়তো বা শাঁখচিল শালিকের বেশে, হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিঁকের নবান্নের দেশে কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়। হয়তো বা হাঁস হবো - কিশোরীর - ঘুঙুর রহিবে লাল পায় সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে। আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে জলঙ্গীর ঢেউ এ ভেজা বাংলারি সবুজ করুণ ডাঙ্গায়।
হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে।
হয়তো শুনিবে এক লক্ষীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে।
হয়তো খৈয়ের ধান সরাতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে।
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙ্গা বায় - রাঙ্গা মেঘে সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে,
দেখিবে ধবল বক; আমারে পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে।
শুনেছি তখন আমার দুই বছর- অহিংসার সাধক আমার বাবা পুড়ে গেল বন্ধুর হিংসাযজ্ঞে, জীবনে পায়নি ‘বুদ্ধ-শান্তি’, মরণে পেল আমার বেদনার ছোট্ট দিঘীটাও সেইদিনই তৈরী হল।
তারপর মা, আমার চিরবঞ্চিত-শৈশবের সর্বত্রাতা বিপদনাশিনী মা, স্বামীর লাল চিতা নিবে গেছে ঠিকই, কিন্তু শাড়ি বেয়ে সাদা আগুন লেগে গেছে সমস্ত সত্ত্বায় দশদিক ভরে গেছে পাহাড়ের মত অনড় শ্বেত-আগুনে পড়শি পুরুষের ছোঁক-ছোঁক, স্বামীর ভিটায় আত্মীয়দের চোখ, অর্ধাহারে শিশুপুত্র - কতবার যে সতীদাহ হল মাথার আর কী দোষ – এভাবে কতদিন ঠিক থাকে? তাও দিন কাটছিল, কিন্তু যেদিন মা সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেল আমার বেদনার দিঘীটা একলাফে নদীর রূপ নিল।
দেখতে দেখতে দেড় যুগ হতে চলল- প্রতি বছরের মত চৈত্রসংক্রান্তিতে পুকুরে নেমে ডাব খাব, হঠাৎ - ডাবের জলে একটা ছায়া – একটা জলরঙা মেয়ের ঘোর লাগানো ছায়া ও এল, জলের মতই কলকল উচ্ছ্বল – আমার নিবু এল, কিছুই না-পাওয়া জীবনে এই প্রথম বুঝলাম - পাওয়া কাকে বলে টের পেলাম অলির আনন্দ কদিনের জন্য বেদনার নদীটা আমার শুকিয়েই গেল । যাবার সময় জোড়া শালিক সাক্ষী করে নিবু বলে গেল- আসছে চৈত্রসংক্রান্তিতে তোমাদের সিঁদুরে আমগাছতলায় সিঁদুর পড়ব কণ্ঠীবদলের পালা হবে। অলির আনন্দ শেষে শুরু হল চাতকের আকাশ চাওয়া হায়, একে একে কেঁটে গেল আঠারোটি সংক্রান্তি- সিঁদুরে আমগাছে সিঁদুরে আম ধরে সিঁদুর পড়া কেউ আসে না – আমার একলা ঘরে। এই আঠারো বছরে আমার বেদনার নদীটা আঠারোটি সাগর হয়ে গেছে।
আমারে লইয়া সুখী হও তুমি ওগো দেবী শবাসনা, আর খুঁজিও না মানব-শোনিত, আর তুমি খুঁজিও না। আর মানুষের হৃত্ পিণ্ডটা নিওনা খড়গে ছিঁড়ে, হাহকার তুমি তুলো না গো আর সুখের নিভৃত নীড়ে। এই দেখ আমি উঠেছি ফুটিয়া উজলি পুষ্পসভা, ব্যথিত ধরার হৃত্ পিণ্ডটি আমি যে রক্তজবা। তোমার চরণে নিবেদিত আমি, আমি যে তোমার বলি, দৃষ্টি-ভোগের রাঙ্গা খর্পরে রক্ত কলিজা-কলি। আমারে লইয়া খুশি হও ওগো, নম দেবি নম নম, ধরার অর্ঘ্য করিয়া গ্রহণ, ধরার শিশুরে ক্ষম।
জাগো মুসলিম জেগে ওঠো আর থেকোনা ঘুমে, ইসলামের আজ দুর্দিন তাই আর থেকো না রুমে । গর্জে ওঠো সবাই এবার উড়াও দিনের নিশান, ভয় করোনা বিধর্মীদের থাকতে দেহে প্রাণ । বিধর্মীরা ইসলাম ধংসের করছে পাঁয়তারা, মুসলিম নামের লেবাছ পরা মুসলমানদের দ্বারা । তাদের শক্তি যতই বড় হোক ইসলামের থেকে নয় , যুগে যুগে বীজিত মুসলিম তাই করুনা ভয় । দ্বীনের আলো ছড়িয়ে দাও সকল লোকের মাঝে , তারা যেন না যাই ভুলে সকল কাজে । যে কাজেতে তিনি মোদের পেরন করলেন ভবে , সে কাজ যেন সবার আগে করি মোরা সবে ।
পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও- ঘরে আছে ছোট বোনটি তারে নিয়ে যাও। কপিল-সারি গাইয়ের দুধ যেয়ো পান করে’ কৌটা ভরি সিঁদুর দেব কপালটি ভরে’! গুয়ার গায়ে ফুল চন্দন দেব ঘসে’ ঘসে’, মামা-বাড়ীর বলব কথা শুনো বসে বসে!
কে যাওরে পাল ভরে’ কোন্ দেশে ঘর পাছা নায়ে বসে আছে কোন্ সওদাগর? কোন্ দেশে কোন্ গাঁয়ে হিরে ফুল ঝরে। কোন্ দেশে হিরামন পাখী বাস করে! কোন্ দেশে রাজ-কনে খালি ঘুম যায়, ঘুম যায় আর হাসে হিম্-সিম্ বায় | সেই দেশে যাব আমি কিছু নাহি চাই, ছোট মোর বোনটিরে যদি সাথে পাই!
পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও, তোমার যে পাল নাচে ফুলঝুরি বাও। তোমার যে না’র ছই আবের ঢাকনী ঝলমল জ্বলিতেছে সোনার বাঁধনী। সোনার না বাঁধন্ রে তার গোড়ে গোড়ে হিরামন পঙ্খীর লাল পাখা ওড়ে। তারপর ওড়েরে ঝালরের ছাতি, ঝলমল জলে জ্বলে রতনের বাতি। এই নাও বেয়ে যায় কোন্ সদাগর, কয়ে যাও—কয়ে যাও কোন্ দেশে ঘর?
পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও, ঘরে আছে ছোট বোন্ তারে নিয়ে যাও,— চেনা গাঙে সাত ধার করে গলাগলি, সেথা বাস কেহেলার—লোকে গেছে বলি। পারাপার দুই নদী—মাঝে বালুচর সেইখানে বাস করে চাঁদ সওদাগর। এ পারে ধুতুমের বাসা ও পারেতে টিয়া— সেখানেতে যেও না রে নাও খানি নিয়া। ভাইটাল গাঙ্ দোলে ভাটা গেঁয়ো সোতে, হবে নারে নাও বাওয়া সেথা কোন মতে।
বৃষ্টি এল কাশ বনে জাগল সাড়া ঘাস বনে, বকের সারি কোথা রে লুকিয়ে গেল বাঁশ বনে। নদীতে নাই খেয়া যে, ডাকল দূরে দেয়া যে, কোন সে বনের আড়ালে ফুটল আবার কেয়া যে। গাঁয়ের নামটি হাটখোলা, বিষটি বাদল দেয় দোলা, রাখাল ছেলে মেঘ দেখে, যায় দাঁড়িয়ে পথ-ভোলা। মেঘের আঁধার মন টানে, যায় সে ছুটে কোন খানে, আউশ ধানের মাঠ ছেড়ে আমন ধানের দেশ পানে।
সুকুমার রায় (১৮৮৭ - ১৯২৩) একজন বাঙালি শিশুসাহিত্যিক ও ভারতীয় সাহিত্যে "ননসেন্স্ রাইমের" প্রবর্তক। তিনি একাধারে লেখক, ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, রম্যরচনাকার ও নাট্যকার। তিনি ছিলেন জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সন্তান এবং তাঁর পুত্র খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। তাঁর লেখা কবিতার বই আবোল তাবোল, গল্প হযবরল, গল্প সংকলন পাগলা দাশু, এবং নাটক চলচ্চিত্তচঞ্চরী বিশ্বসাহিত্যে সর্বযুগের সেরা "ননসেন্স" ধরণের ব্যঙ্গাত্মক শিশুসাহিত্যের অন্যতম বলে মনে করা হয়, কেবল অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড ইত্যাদি কয়েকটি মুষ্টিমেয় ক্লাসিক-ই যাদের সমকক্ষ। মৃত্যুর আশি বছর পরও তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম শিশুসাহিত্যিকদের একজন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ই মে কলকাতার এক ধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিঁনি ছিলেন অগ্রণী বাঙ্গালী কবি, ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, কন্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ্য সাহিত্যিক মনে করা হয়। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজী অনুবাদের জন্য তাঁকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। ইউরোপের বাহিরের প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসাবে তিনি বিশ্বে ব্যপক খ্যাতি লাভ করেন। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালের ৭ই অগাস্ট জোড়াসাঁকোর বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে মৃত্যুর সাত দিন আগে পর্যন্ত তিঁনি সৃষ্টিশীল ছিলেন।
যতীন্দ্রমোহন বাগচী ১৮৭৮ সালের ২৭শে নভেম্বর নদিয়ার জমসেদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতার ডাফ কলেজ (বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজ) থেকে তিনি স্নাতক পাশ করেন। বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকীতে তিনি নিয়মিতি লেখালেখি করতেন। ১৯০৯ থেকে নিয়ে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত তিনি সাহিত্য পত্রিকা মানসী-র সম্পাদনায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯২১ থেকে নিয়ে বছরখানেক তিনি অপর এক সাহিত্য সাময়িকী যমুনা-র যুগ্ম সম্পাদক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৪৭-৪৮ সালে তিনি নজস্ব পত্রিকা পূর্বাচল চালু করেন এবং এর সম্পাদনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। তাঁর কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তাধারার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এছাড়াও তার কবিতায় প্রত্যন্ত বাংলার হাসি-কান্নার রূপ অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে ফুটে উঠেছে। ১৯৪৮ সালের ১লা ফেব্রুয়ারী যতীন্দ্রমোহন বাগচী মৃত্যুবরণ করেন।
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই, মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই? পুকুর ধারে লেবুর তলে থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই- মাগো আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই? সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো;- দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো? খাবার খেতে আসি যখন, দিদি বলে ডাকি তখন, ওঘর থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো? আমি ডাকি তুমি কেন চুপটি করে থাকো? বল মা দিদি কোথায় গেছে, আসবে আবার কবে? কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল-বিয়ে হবে! দিদির মত ফাঁকি দিয়ে, আমিও যদি লুকাই গিয়ে তুমি তখন একলা ঘরে কেমন করে রবে, আমিও নাই-দিদিও নাই- কেমন মজা হবে। ভুঁই চাপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল, মাড়াস্ নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল। ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে বুলবুলিটি লুকিয়ে থাকে, উড়িয়ে তুমি দিও না মা, ছিঁড়তে গিয়ে ফল,- দিদি এসে শুনবে যখন, বলবি কি মা বল! বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই- এমন সময় মাগো আমার কাজলা দিদি কই? লেবুর ধারে পুকুর পাড়ে ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোপে ঝাড়ে’ ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, তাইতে জেগে রই রাত্রি হলো মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও -
ঘরে আছে ছোট বোনটি তারে নিয়ে যাও।
কপিল-সারি গাইয়ের দুধ যেয়ো পান করে’
কৌটা ভরি সিঁদুর দেব কপালটি ভরে’!
গুয়ার গায়ে ফুল চন্দন দেব ঘসে’ ঘসে’, মামা-বাড়ীর বলব কথা শুনো বসে বসে!
কে যাওরে পাল ভরে’ কোন্ দেশে ঘর
পাছা নায়ে বসে আছে কোন্ সওদাগর?
কোন্ দেশে কোন্ গাঁয়ে হিরে ফুল ঝরে।
কোন্ দেশে হিরামন পাখী বাস করে!
কোন্ দেশে রাজ-কনে খালি ঘুম যায়,
ঘুম যায় আর হাসে হিম্-সিম্ বায়।
সেই দেশে যাব আমি কিছু নাহি চাই,
ছোট মোর বোনটিরে যদি সাথে পাই!
পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও,
তোমার যে পাল নাচে ফুলঝুরি বাও।
তোমার যে না’র ছই আবের ঢাকনী
ঝলমল জ্বলিতেছে সোনার বাঁধনী।
সোনার না বাঁধন্ রে তার গোড়ে গোড়ে
হিরামন পঙ্খীর লাল পাখা ওড়ে।
তারপর ওড়েরে ঝালরের ছাতি,
ঝলমল জলে জ্বলে রতনের বাতি।
এই নাও বেয়ে যায় কোন্ সদাগর,
কয়ে যাও – কয়ে যাও কোন্ দেশে ঘর?
পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও,
ঘরে আছে ছোট বোন্ তারে নিয়ে যাও, -
চেনা গাঙে সাত ধার করে গলাগলি,
সেথা বাস কেহেলার – লোকে গেছে বলি।
পারাপার দুই নদী – মাঝে বালুচর
সেইখানে বাস করে চাঁদ সওদাগর।
এ পারে ধুতুমের বাসা ও পারেতে টিয়া -
সেখানেতে যেও না রে নাও খানি নিয়া।
ভাইটাল গাঙ্ দোলে ভাটা গেঁয়ো সোতে,
হবে নারে নাও বাওয়া সেথা কোন মতে।
হঠাৎ করে গভীর রাতে ফুটল তোমার প্রেমের ফুল সেই রাতেই সেই ফুলের মাঝে বসেই আমি পেলাম কত সুখ ।
প্রেম দিয়ে কি প্রেম পাওয়া যায় ভালবাসা দিয়ে সুখ। প্রেমের ভিতর লুকিয়ে আছে অসাণ্তি নামক ভৃত । ভালবাসা দিয়ে কি ভালবাসা পাওয়া যায় । প্রেম দিয়ে সুখ ভালবাসার ভিতর লুকিয়ে আছে অসাণ্তি নামক ভৃত ।
অনদকার হৃদয়ের মাঝে কে তুমি দিতে পার জালিয়ে মুমের আলো । সেই আলোতেই দেখে নেব আমি কে মোরে ভাস গো ভাল ।
হার-মানা হার পরাব তোমার গলে- দূরে রব কত আপন বলের ছলে। জানি আমি জানি ভেসে যাবে আভিমান- নিবিড় ব্যথায় ফাটিয়া পড়িবে প্রাণ, শূন্য হিঁয়ার বাঁশিতে বাজিবে গান, পাষাণ তখন গলিবে নয়নজলে।
সবচেয়ে যে ছোট পিড়ি খানি সেখানি আর কেউ রাখেনা পেতে, ছোটথালায় হয় নাকো ভাতবাড়া জল ভরে না ছোট্ট গেলাসেতে। বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে যে ছোট খাবার বেলা কেউ ডাকে না তাকে। সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল, তারই খাওয়া ঘুচেছে সব আগে।
সবচেয়ে যে অল্পে ছিল খুশি, খুশি ছিল ঘেষাঘেষির ঘরে, সেই গেছে হায়, হাওয়ার সঙ্গে মিশে, দিয়ে গেছে জায়গা খালি করে। ছেড়ে গেছে পুতুল, পুঁতির মালা, ছেড়ে গেছে মায়ের কোলের দাবি। ভয়ভরা সে ছিল যে সব চেয়ে সেই খুলেছে আঁধার ঘরের চাবি।
হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে ওরে! হারিয়ে গেছে 'বোল' বলা সেই বাঁশি দুধে ধোওয়া কচি সে মুখখানি আঁচল খুলে হঠাৎ স্রোতের জলে ভেসে গেছে শিউলী ফুলের রাশি, ঢুকেছে হায় শশ্মান ঘরের মাঝে ঘর ছেড়ে হায় হৃদয় শশ্মানবাসী।
সবচেয়ে যে ছোট কাপড়গুলি সেইগুলি কেউ দেয় না মেলে ছাদে, যে শয্যাটি সবার চেয়ে ছোট, আজকে সেটি শূন্য পড়ে কাঁদে। সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল সেই গিয়েছে সবার আগে সরে। ছোট্ট যে জন ছিল রে সবচেয়ে, সেই দিয়েছে সকল শূন্য করে।
তুমি আমার ভালবাসা তুমি আমার প্রান তুমি আমার হাসিকাননা তুমি আমার জান ৷ তুমি আমার হৃদয় জুরে একটু উদাস হওয়া ইচেছ মত ভালবাসা অনেক খানি পাওয়া তুমি আমার ভুরের পাখি নিশি জাগা চাঁদ তাইতো জাগে হ্মনে হ্মণে তোমাই পাওয়ার সাদ ।
বেকসুর আমি তবু আমাকেই মৃত্যুদন্ড দিলে! কী করে তোমার কাছে অপরাধী, এখনও জানি না; কস্মিনকালেও আমি শত্রুতা সাধিনি, শুধু বীনা, অলৌকিক, প্রেমময়, বাজিয়েছি। সেই সুরে ছিলে মিশে তুমি বসন্তের পাতার গভীরে, শান্ত ঝিলে, শস্যক্ষেতে নীলিমায়। এই কি আমার অপরাধ? আমার সর্বস্ব দিয়ে রাত্রিদিন একটি নিখাদ প্রেমস্বপ্ন গড়ি, তা-ও ভেঙ্গে যায় কী কর্কশ ঢিলে। আমাকে পাঠালে নির্বাসনে, দিলে দন্ড ভয়ংকর। তোমার সান্নিধ্য থেকে, অমন দৃষ্টির থেকে দূরে, বহুদুরে চকিতে সরিয়ে দিলে- এই শাস্তি, বলো, মৃতের চেয়েও বেশি, ঢের বেশি নয় কি কঠোর___? তুমি কি দেখতে চাও সর্বদা আমার ছলছল চোখ? চাও আমার হৃদয় খাক কীট কুরে-কুরে?
এই নেয়েছ, ভাত খেয়েছ, ঘন্টাখানেক হবে- আবার কেন হঠাৎ হেন নামলে এখন টবে? একলা ঘরে ফুর্তি ভরে লুকিয়ে দুপুরবেলা, স্নানের ছলে ঠান্ডা জলে জল ছপ্ছপ্ খেলা। জল ছিটিয়ে, টব পিটিয়ে, ভাবছ, "আমোদ ভারি- কেউ কাছে নাই, যা খুশি তাই করতে এখন পারি।" চুপ্ চুপ্ চুপ্- ঐ দুপ্ দুপ্! ঐ জেগেছে মাসি, আসছে ধেয়ে, শুনতে পেয়ে দুষ্ট মেয়ের হাসি।
যদি প্রেম দিল না প্রাণে কেন ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে? কেন তারার মালা গাঁথা, কেন ফুলের শয়ন পাতা, কেন দখিন হাওয়া গোপন কথা জানায় কানে কানে?। যদি প্রেম দিলে না প্রাণে কেন আকাশ তবে এমন চাওয়া চায় এ মুখের পানে? তবে ক্ষণে ক্ষণে কেন আমার হৃদয় পাগল হেন, তরী সেই সাগরে ভাসায় যাহার কূলসে নাহি জানে?।
এই যে নদী নদীর জোয়ার নৌকা সারে সারে, একলা বসে আপন মনে বসে নদীর ধারে এই ছবিটি চেনা। মনের মধ্যে যখন খুশি এই ছবিটি আঁকি এক পাশে তার জারুল গাছে দুটি হলুদ পাখি, এমনি পাওয়া এই ছবিটি করিতে নয় কেনা। মাঠের পরে মাঠ চলেছে নেই যেন এর শেষ নানা কাজের মানুষগুলো আছে নানান বেশ, মাঠের মানুষ যাই মাঠে আর হাটের মানুষ হাটে, দেখে দেখে একটি ছেলের সারাটা দিন কাটে। এই ছেলেটির মুখ সারা দেশের সব ছেলেদের মুখেতে টুক টুক।
আমি চিরদুর্দ্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস,
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর!
আমি দুর্ব্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ'লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃংখল!
আমি মানি নাকো কোনো আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম,
ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জ্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর!
আমি বিদ্রোহী আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর!
বল বীর -
চির উন্নত মম শির!
আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণী,
আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণী!
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি চল-চঞ্চল, ঠুমকি' ছমকি'
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি'
ফিং দিয়া দিই তিন দোল্!
আমি চপলা-চপল হিন্দোল!
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা',
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা,
আমি উদ্দাম, আমি ঝঞ্ঝা!
আমি মহামারী, আমি ভীতি এ ধরিত্রীর।
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর।
বল বীর -
আমি চির-উন্নত শির!
আমি চির-দুরন্ত-দুর্ম্মদ,
আমি দুর্দ্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দ্দম্ হ্যায়্ হর্দ্দম্
ভরপুর মদ।
আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক, জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি!
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান।
আমি ইন্দ্রাণি-সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য্য,
মম এক হাতে-বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য্য।
আমি কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির।
আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
বল বীর -
চির উন্নত মম শির।
আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক!
আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনা ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!
আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি ইস্ত্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার,
আমি পিনাক-পাণির ডমরু-ত্রিশূল, ধর্ম্মরাজের দন্ড,
আমি চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ-প্রচন্ড!
আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব!
আমি প্রাণ-খোলা-হাসি উল্লাস, - আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস,
আমি মহা-প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস!
আমি কভু প্রশান্ত, - কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্প-হারী!
আমি প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল,
আমি উজ্জ্বল আমি প্রোজ্জ্বল,
আমি উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল্ দোল!
আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি,
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম-উদ্দাম, আমি ধন্যি।
আমি উন্মন মন উদাসীর,
আমি বিধাতার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর!
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত
বুকে গতি ফের!
আমি অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিত- চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর!
আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক'রে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা'র কাঁকন-চুড়ির কন্-কন্।
আমি চির-শিশু, চির-কিশোর,
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর!
আমি উত্তর-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাসী পূরবী হাওয়া,
আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীনে গান গাওয়া!
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র রবি,
আমি মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি! -
আমি তুরিয়ানন্দে ছুটে চলি এ কি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে
সব বাঁধ!
আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন,
আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব বিজয় কেতন!
ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া
স্বর্গ-মর্ত্ত্য করতলে,
তাজি বোরবাক্ আর উচ্চৈস্রবা বাহন আমার
হিম্মত-হ্রেস্বা হেঁকে চলে!
আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি, কালানল,
আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথর-কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া, দিয়া লম্ফ,
আণি ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা, সঞ্চরি' ভূমি-কম্প!
ধরি বাসুকির ফনা জাপটি', -
ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি'!
আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,
আমি ধৃষ্ট আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!
আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
মহা- সিন্ধু উতলা ঘুম্-ঘুম্
ঘুম্ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম্
মম বাঁশরী তানে পাশরি'
আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।
আমি রুষে উঠে' যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে সপ্ত নরক হারিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!
আমি প্লাবন-বন্যা,
কভু ধরণীরে করি বরণিয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা -
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণি!
আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!
আমি মৃণ্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়!
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির দুর্জ্জয়,
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ-পাতাল-মর্ত্ত্য
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে
সব বাঁধ!!
আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার,
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!
আমি হল বলরাম স্কন্ধে,
আমি উপাড়ি' ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।
মহা- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না -
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি আমি সেই দিন হব শান্ত!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব-ভিন্ন!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি চির-বিদ্রোহী বীর -
আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!